অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা গতিপথ পরিবর্তন করে মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানলেও এর অগ্রভাগের তাণ্ডব বয়ে গেছে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের উপর দিয়ে। মোখার কবল থেকে রক্ষা পায়নি নারকেল জিঞ্জিরা খ্যাত এ দ্বীপ।
গত ১৪ মে মোখার তাণ্ডবে সেন্টমার্টিনের পর্যটন খাতে ২ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে হোটেল ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে।
হোটেল রিসোর্ট সমিতির তথ্য অনুযায়ী, সেন্টমার্টিনে এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৩ হাজারের অধিক মানুষ সহায় সম্বল হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো কঠিন বিপদের মধ্যে।
সরকারি সহায়তাও এখনো তাদের কাছে পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। করেনার মহামারিতেও সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রে উপক্ষিত, এবার মোখায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও কোনো সহায়তা পাননি বলে একাধিক পর্যটন ব্যবসায়ীর অভিযোগ।
সেন্টমার্টিন মারমেইড রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী তৈয়ব উল্লাহ বলেন, ‘সেন্টমার্টিনের দুই শতাধিক রিসোর্টের মধ্যে প্রায় সব রিসোর্টে কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রতি রিসোর্টে ১ লাখ টাকা করে হিসেব করলেও ২০০ রিসোর্টে ২ কোটি টাকা মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কারো কারো বেশি হয়েছে। আবার কারো কম হয়েছে। যেমন ৬ লাখের বেশি ক্ষতি হয়েছে এমন রিসোর্টও আছে।’
তৈয়ব উল্লাহ আরও বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখায় পর্যটনের অন্যতম খাত সেন্টমার্টিনের যে ক্ষতি হয়েছে তা ১০ বছরেও পূরণ করাটা কঠিন হয়ে যাবে। হোটেল-রিসোর্ট ও সাধারণ মানুষের যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। বিশেষ করে সমুদ্রের পাশে যে রিসোর্টগুলো ছিলো তাদের বিরাট ক্ষতি হয়েছে। এসব রিসোর্টের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য থাকা গাছগুলো ভেঙে গেছে, সৌন্দর্য পুনরায় ফিরে আনতে অনেক বছর লাগতে পারে।’
সেন্টমার্টিন বিচ ইকো রিসোর্টের ম্যানেজার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে দ্বীপে অনেক হোটেল রিসোর্টের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ফলে অনেক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন। অফ সিজনে অন্তত ভালো থাকলেও ঘূর্ণিঝড়ের পর হোটেলগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়ায় কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দুর্দশা যাচ্ছে।’
সেন্টমার্টিন হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম জিহাদী বলেন, ‘ঝড়ের পর প্রতিটি হোটেলে জনবলের সংখ্য কমে এসেছে। অন্যান্য সময় একেকটি হোটেলে ৮ থেকে ১০ জন থাকলেও সেই সংখ্যা এখন অর্ধেকের চেয়ে কম। যেমন আমার ‘সী প্রবাল বিচ রিসোর্টে’ মাত্র ২ জন লোক রয়েছে। বেতন পরিশোধে অনেকে হিমশিম খাওয়ায় এতো বেশি জনবল রাখার সাহস পাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, ‘এবারের ঘূর্ণিঝড়ে হোটেল-রিসোর্টগুলোতে ক্ষয়ক্ষতি ২ কোটির উপরে ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু আমরা এখনো পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রণোদনা পাইনি। শুধু এবার বলে কথা না, করোনার মহামারীতেও আমাদের সংকট সময়ে কোনো সহায়তা পাইনি। তাই সেন্টমার্টিনের পর্যটন খাতকে টিকিয়ে রাখতে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন করবো।’
সেন্টমার্টিন হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে আমাদের হিসেব মতে ২ শতাধিক হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে। ঘূণিঝড়ের তাণ্ডবে কিছু কিছু দ্বিতলা বিশিষ্ট রিসোর্টের ছাউনি উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আবার কিছু কিছু রিসোর্টের বিরাট ক্ষতি না হলেও গাছপালা ভেঙেছে। হোটেল-রেস্তোঁরা গুলোর ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতির পূর্ণাঙ্গভাবে হিসেব না করলেও ২ কোটির মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা প্রাথমিক ধারণা করেছি। সবমিলিয়ে হিসেব করলে বরং এরচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা দেখছি।’
সভাপতি আরও বলেন, ‘প্রতিটি হোটেলে ১০ জন করে জনবল হিসেবে করলেও জীবন জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তায় প্রায় ২০০০ জনবল। এছাড়াও ৪০০ শতাধিক মানুষ মৎস্যখাতে জড়িত রয়েছে যারা বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁয় মাছ সরবরাহ করে সেন্টমার্টিনের পর্যটন খাতে ভুমিকা রাখছে। তারা নিষেধাজ্ঞা থাকায় এখন সাগরেও যেতে পারছে না। সেদিক থেকেও পর্যটন খাতে ধস নামছে। সবমিলিয়ে সেন্টমার্টিনের পর্যটন খাত এখন দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই। তাই সরকারিভাবে আমাদের পুনবার্সন প্রয়োজন।’
সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখায় দ্বীপবাসীর বিরাট ক্ষতি হয়েছে। মোখার বাতাসে এ দ্বীপের ৭০০ বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ২৫০ থেকে ৩০০ সেমিপাকা ঘরের ছাউনি উড়ে গেছে বাতাসে। এবং ১০০ এর বেশি দোকানপাট তছনছ হয়ে গেছে। এছাড়া হোটেল-রিসোর্টগুলোরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যা পর্যটনখাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। জেলা প্রশাসনের কাছে দাবি করেছি দ্বীপের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্য সরকারিভাবে সাহায্য-সহায়তা প্রদান করা হয়।’
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় মোখায় সেন্টমার্টিনে বাড়িঘরসহ বেশকিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে আমাদের সহায়তা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দ্বীপের ক্ষতিগ্রস্ত কেউ যেন সহায়তা থেকে বাদ না যায় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে সহায়তার জন্য আমরা আশ্বস্ত করেছি।’