আমি, বাবা আর বাইক ll তৌহিদ মিজান

সন্ধ্যায় আমার বাবা একটা সিলভার কালারের সিডিআই হোন্ডা H100s মডেলের মোটরসাইকেল নিয়ে বাসায় আসলেন। ঘরে তুলতেই আমাকে বসিয়ে দেয়া হলো মোটরসাইকেলটার উপরে। বাকিটা ইতিহাস, এমন গল্পটাই আম্মু আমাকে বলছিলেন বড় হবার পরে। ওই দিন নাকি সেই আড়াই বছরের আমি মাঝ রাত পর্যন্ত সেই বাইকের উপরে বসে ভুম ভুম করতে ছিলাম। কেউ বিছানায় নিতে পারেননি।
সেই ছোট বেলা থেকেই বাইকের প্রতি অন্যরকম একটা ভালোবাসা কাজ করে। তখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ি। আব্বু তার সিলভার কালারের বাইকটা পরিবর্তন করে এই মডেলের লাল রঙের একটা বাইক নিয়েছেন। আমি ছোট থাকায় আমাকে বাইকের ট্যাঙ্কির উপরেই বসাতেন। বাইক স্টার্ট দেয়ার পরে এক্সেলারেটর নিয়ে ভুম ভুম করার অভ্যাসটা সেই ছোট্টকাল থেকেই। চান্স পেলেই ভুম ভুম। আর এভাবেই শুরু।
একদিন আব্বুর সামনে বসা আমি। বাইক চলছিলো। হঠাৎ-ই আমাকে বলে উঠলেন- নেও ভুম ভুম করো। আমি হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ভুম করা শুরু করলাম। আব্বু খুব নিশ্চিন্তে তার ডান হাত এক্সেলারেটর থেকে সরিয়ে নিলেন। আমিও অবাকভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই থেকেই শুরু আমার ভুম ভুম……
বিকেলে সময় পেলেই আমি আব্বুর সাথে বাইকের সামনে ট্যাঙ্কির উপর বসে পরতাম। আব্বু বাইক রানিং করে আমাকে দিয়ে দিতো ভুম ভুম করতে। আমি শুধু গিয়ার পরিবর্তন করতে পারতাম না, আর স্লো হলে দাঁড়াতে পারতাম না- হাঁ হাঁ ….
এরপর কেটে গেলো অনেক বছর। হাইস্কুলে থাকতে আব্বুর বাইক নিয়ে বিকেল বা ছুটির দিনে একা একা বেরিয়ে পড়তাম। বিষয়টা পরিবার কখনো নেগিটিভ ভাবে নেয়নি। কারণ রক্তেই মিশে আছে ওই পেট্রোল আর সাইলেন্সারের পোড়া মবিলের গন্ধ।
আমাদের বাইকের সার্ভিসিং কিংবা টুকটাক কাজ আব্বু নিজেই করতেন। তা দেখে দেখে আমিও অনেক খুটিনাটি বিষয় শিখে গিয়েছি। প্লাগ পরিষ্কার করা, এক্সেলারেটরের তার পরিবর্তন করা বা ছিড়ে গেলে কীভাবে চালিয়ে নিয়ে আসতে হবে অথবা ওয়েল পিস্টন খুলে রাখলে যে আর বাইক স্টার্ট দেয়া সম্ভব না এমন কিছু ট্রিক্স। কিংবা শুক্রবার দল বেঁধে (আমি, ছোট মামা, মেজো মামা ) পুকুর ঘাটে গিয়ে বাইক ধোয়া রীতিমত রুটিন হয়ে গিয়েছিল তখন।

একটু বড় হওয়ার পর, মানে কলেজে ওঠার পর মনের ভিতর খচখচ করত, নিজের একটা বাইকের জন্য। ১৮ হওয়ার সাথে সাথেই একটা ড্রাইভিং লাইসেন্সও হয়ে গেলো আমার। কে ঠেকায় এখন। সড়ক মহাসড়কে বাইক নিয়ে চলাচল করার আর কোন বাধাই রইলো না আমার।
ভার্সিটিতে পড়াশুনা করা অবস্থায়ই আর যেন তর সইছে না, নিজের একটা বাইক কেনার জন্য ছটফট করছি। কিন্তু কেন জানি কোনোভাবেই হচ্ছিলো না। হয়তো বাসায় বললে কিনে দিবে কিন্তু তেলের টাকা? সে যাই হোক মনে মনে ভাবতে থাকলাম নিজের টাকা দিয়েই বাইক কিনবো। এর মধ্যে একটা সফটওয়ার কোম্পানিতে জয়েন করলাম। শুরু করলাম একটু একটু করে বাইক কেনার জন্য টাকা জমানো।
এরই মধ্যে ফেসবুকের কিছু গ্রুপের সাথে যুক্ত হলাম। যেমন- বাইকবিডি, দুই চাক্কার গ্রুপ ইত্যাদি। যতটুকু মনে পড়ে, সেই ২০১৫ সালের দিকে বাইকবিহীন আমি মাঝে মাঝেই বাইকবিডিতে পোস্টও দিতাম ‘আমার মত কেউ কি আছেন এই গ্রুপে যার বাইক নাই’, কিংবা ‘বি _ ড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়ে মাসে কত টাকা জমালে একটা পালসার কেনা যাবে? ‘-বিষয়টা লিখতে এখন একটু হাসিই পাচ্ছে।

এখন নিজের একটা বাইক আছে, নিজের টাকায়ই কেনা। ছোট বেলার ভুম ভুম করার অভ্যাসটাও রয়ে গেছে আজও। নিজের প্রয়োজনেই নিয়েছি বাইকটাকে। বাইকটার একটা নামও দিয়েছি। ওর নাম ব্লু -বি। ২৮ ফেব্রুয়ারি ওর জন্মদিন। নিজের বলেই যত্নটাও নিজের শরীরের মতই নেই। ওর জন্মদিনের উপহারগুলো ছিল দারুণ দারুণ। যেমন- নতুন ক্লাচ প্লেট, দুইটা নতুন টায়ার (আমার বৌ দিয়েছে), দুইটা চাকার ব্রেক প্যাড কিট…… প্রতিদিন প্রায় ৩০ কিলোমিটার আমাকে বয়ে নিয়ে বেড়ায় আমার ‘ব্লু -বি’। এখন পর্যন্ত চল্লিশ হাজারের বেশি চলেছে। কখনো রাস্তায় নিরাশ করেনি আমাকে। একবারে সর্বোচ্চ ৬০০ কিলোমিটার রাস্তাও এক সাথে চলেছি। তবুও রাস্তায় একবারের জন্যও হয়রান হয়নি আমার ব্লু -বি।
চাকরি ঢাকায় আর বাড়ি বরিশাল। আর মাঝে প্রমত্ত পদ্মা। পদ্মা সেতু নিয়ে আমার আর ব্লু -বি’র স্বপ্নেরও কমতি ছিলা না। মা-বাবা কে বলেছিলাম, ‘পদ্মা সেতু যেই দিন উদ্বোধন হবে তার পরে দিনই ছুটি নিয়ে সকাল সকাল বাইক নিয়ে বাড়ি চলে আসবো। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইক নিয়ে ঘাটে বসে থাকতে হবে না। সকাল সকাল রওনা দিলে সকালের নাস্তা এক সাথে করতে পারবো। দুপুরে এক সাথে খাওয়া দাওয়া করে আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসতে পারবো’।
২৭ জুন ২০২২, জানতে পারলাম পদ্মা সেতুতে নাকি বাইক চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। শুনে বুকের মাঝে চিন চিন করে উঠছে। মাকে কল করেই বললাম, পদ্মা সেতুতে বাইক নিষিদ্ধ, আমি আসব না, বাইকও বেঁচে দিবো। যদিও আম্মু বলেছিলেন, ‘থাক মন খারাপ করিস না, আর রাগ করে আবার বাইক বিক্রি করে দিস না’। সেই বুক ভাঙার অনুভূতির কথা লিখে বোঝানো যাবে না।
মরার উপর খারার ঘা, ভালবাসার সেই বাইক নিয়ে দেশে শুরু হয়েছে নতুন চক্রান্ত। মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা ২০২৩ নামক একটা বাইক বিরোধী আইন প্রণয়নের পাঁয়তারা চলছে।

বাইক যে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় বাহন তা নতুন করে কাউকে বোঝানোর দরকার নেই। অল্প সময়ে যাতায়াত, সহজেই এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাওয়া, কিংবা লং ট্যুর, যাই হোক বাইকের কোন জুরি নেই। অফিসের কাজে বা ব্যবসার কাজে বাইক লক্ষ লক্ষ মানুষের খরচ বাঁচিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে আমার মতো অগণিত সীমিত আয়ের মানুষদের ভরসা হল এই বাইক। একটা বাইক থাকলে ঈদপার্বণের ছুটিতে বাসের টিকেট কাটার ঝামেলা থাকে না। অফিস করেই ধীরে সুস্থে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়া যায়। আর এভাবেই তৈরি হয় বাইক আর বাইকারের মধ্যে একটা অদৃশ্য সেতু বন্ধনের।
এখন তো বাইক আয়েরও উৎস। হাজার হাজার বেকার যুবকের অবলম্বন এই বাইক। যার উপর নির্ভর করছে তাদের পরিবারের লক্ষ লক্ষ মানুষ। রাইড শেয়ারের মাধ্যমে অনেকই আজ স্বাবলম্বী। ঘুচিয়েছে বেকারত্ব।
বাইকার শব্দটাও একটা আবেগি শব্দ। আমাদের জীবনের সাথে বাইক কেমন জানি ওতোপ্রোতো ভাবে মিশে গিয়েছে। এর জন্যই আবেগটা একটু বেশিই কাজ করে। আপনার সাথে কখনো কি এমন হয়েছে যে, মনটা খুব বিষণ্ণ লাগছে- বাইকটা নিয়ে একটু কোথাও ঘুরে আসি! আর ভুম ভুম করতেই নিমিষে মন ভালো হয়ে গিয়েছে? আমার তো সব সময়েই হয়। মন ভালো করার উপায় হলো ভ্রমণ। আর সাথে যদি একটা মনের মতো বাইক থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা……

বর্তমান বাইকটা নিয়েছি তিন বছর হয়ে গেলো। এরই মাঝে চলে গেলো মহামারি করোনা, লক ডাউন। বন্ধ ছিল গণপরিবহন। ভরসা ছিলো এই বাইক। নিশ্চিন্তে অফিস-বাসা আর মন খারাপ হলে কোথাও হারিয়ে যাওয়া। বাইকের গুরুত্বটা আসলে একজন বাইকারই বুঝতে পারেন, আর কেউ না। আমার বাইকটা আমার কাছে সেরা, আর তাই তো এর যে কোনো ছোটখাটো কিছু হলেই তৎক্ষণাৎ ঠিক করে ফেলি। যেই বাইকটা সব সময় বন্ধুর মত পাশে থাকে তার যত্ন তো সেই ভাবেই নেওয়া উচিৎ। তাই না?
আমাদের দেশের অর্থনীতিতে এই বাইকের অনেক প্রভাব রয়েছে। শিল্প উন্নয়নেও রয়েছে বাইকের অবদান। কোনোভাবেই তা অস্বীকার করা যায় না। বাইক হলো তরুণদের ক্রেজ। বাইক হলো ভরসার আরেক নাম। এর জন্যই বলা হয় ‘এটা কোনো মেশিন নয়-এটা একটা আবেগ’।
Print Friendly, PDF & Email

Related Posts