গ্রেনেড হামলায় নিহত নিরাপত্তারক্ষী মাহবুবুর রশিদের কবর (ইসসেটে মাহবুব)
কাঞ্চন কুমার: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা হয়। সে সময় নিজের জীবন বাজি রেখে যারা নেত্রীর রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিলেন তাদেরই একজন কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ফুলবাড়ি গ্রামের হারুন-অর-রশিদের সন্তান মাহবুবুর রশিদ মাসুদ।
নিজের জীবনের বিনিময়ে নেত্রীর জীবন বাঁচানোর কারণে তিনি ইতিহাসের পাতায় নিজের স্থান করে নিয়েছেন। বাবা-মায়ের চরম অনুগত দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা মাহবুবুর ছেলে বেলা থেকেই শান্ত ও পরোপকারী ছিলেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী দলে নিযুক্ত হন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও নিষ্ঠতার সঙ্গে মাহবুবুর তার দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
মাহবুবুর রশিদের বাবা হারুন অর রশিদ ও মা হাসিনা বেগম এখনও বেঁচে আছেন। শারীরিক নানা অসুস্থতা তাদের নিত্যসঙ্গী। আর মাহবুবুর রশিদের স্ত্রী ছেলেদের নিয়ে ঢাকায় থাকেন। বড় ছেলে আশিক বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং আর ছোট ছেলে রবিন ডাক্তারি পড়া শেষ করেছেন।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জয়ন্তীহাজরা ইউনিয়নের ফুলবাড়ী গ্রামে নিজ ঘরের বিছানায় বসে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কথা বলছিলেন বাবা হারুন অর রশিদ এবং মা হাসিনা বেগম।
তারা জানান, তাদের শারীরিক অবস্থা ভালো না। শরীরে নানা অসুখ। বয়সের ভারে হাসিনা বেগমের শারীরিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে চলেছে। আর বয়োবৃদ্ধ হারুন অর রশিদ প্রোস্টেট ক্যান্সার নিয়ে জীবনসংগ্রাম করে চলেছেন। বাড়ি থেকে খুব একটা বের হন না। কারো সামনেও আসেন না। প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে প্রতি মাসে ৯ হাজার টাকা আর বয়স্ক ভাতার টাকায় তাদের সংসার চলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে তার দরিদ্র পরিবার। তবে বাবা-মায়ের খোঁজ না রাখায় ক্ষোভ রয়েছে নিজের সন্তানদের উপরও।
৮৬ বছরের হারুন অর রশীদ বলেন, আমার পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। মাহবুব তো চলেই গেছে আমাদের ছেড়ে। এক ছেলে, এক মেয়ে ও এক নাতি প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় সরকারি চাকরি পেয়েছে। মাহবুবের স্ত্রী শামীমা আক্তার আছমা তার দুই ছেলে আশিক ও রবিনকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং আর ছোট ছেলে ডাক্তারি পড়েছে শুনেছি। তবে তাদের সাথে যোগাযোগ নেই। তারাও খোঁজ রাখে না। এখন ছোট মেয়ে আবিদা কাছে থাকেন। সেই আমাদের দেখাশুনা করে। মেয়েকে একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারলে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।
স্মৃতিচারণ করে হারুন অর রশীদ জানান, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন। মাহবুবকে বাড়ির পাশের ফুলবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান তিনি। সেখান থেকে মাহবুব পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেন। কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা না থাকায় তাকে তার মামা আবদুর রব নিয়ে গিয়ে রাজবাড়ীর পাংশার বাহাদুরপুর শহীদ খবির উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। মামাবাড়ি থেকেই ১৯৮৪ সালে এসএসসি পাস করেন মাহবুব। তারপর সংসারের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীর মেজর পর্যায়ের এক কর্মকর্তার বাসায় ৬০০ টাকা বেতনে চাকরি নেয় মাহবুব। পরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পান। মাহবুবের চাকরির সুবাদেই দরিদ্র সংসারটি কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখে। নির্দিষ্ট মেয়াদে চাকরি শেষে গ্রামে ফিরে ব্যবসার উদ্যোগও নিয়েছিলো। ২০০০ সালে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেয় মাহবুব। পরে বিশ্বস্ততা ও সততা অর্জন করায় অল্প সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দায়িত্ব পায়।
রোববার (২০ আগস্ট) এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশে ফুলবাড়ী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেছনের কবরস্থানে সরকারি খরচে নির্মিত কাশফুল সাদা পাথরখচিত মাহবুবুর রশিদের সমাধিটি পরিষ্কার করা হয়েছে। প্রতিবছর ২১ আগস্টের আগে নিজ হাতে ছেলের সমাধিস্থলটি পরিষ্কার করতেন বাবা। কিন্তু এ বছর শারিরীক অসুস্থতার কারণে সমাধিস্থল পরিষ্কার করতে না পারায় কষ্ট রয়েছে তার।ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী কীভাবে পালন করবেন জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, মৃত্যুবার্ষিকীতে মেয়েরা দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।
কথা হয় ছোট মেয়ে আবেদা সুলতানার সাথে। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় তিনিও খোকসা উপজেলা পরিষদে চাকরি করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তিনি(শেখ হাসিনা)আমাদের দু’হাত ভরে দিয়েছেন। তার কাছ আর কিছু চাওয়ার নেই। প্রতি বছর সামর্থ্য অনুযায়ী ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি।