আরিফুল ইসলাম সাব্বির: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন সাভারের মাহবুবা পারভীন।তিনি এখনও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রেনেডের ১,৭৯৭টি স্প্লিন্টার।
সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি তাকে তাড়া করে ফেরে প্রতিদিন। শরীরে বিদ্ধ থাকা স্প্লিন্টারের জ্বালাপোড়ায় এখনো সারা রাত ঘুমাতে পারেন না তিনি। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন প্রতিমুহূর্ত । কবে শরীরে শান্তি পাবেন, সেই প্রতীক্ষায় দিন গুনছেন।
ঘটনার দিন শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরপরই আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার কর্মসূচি ছিলো। তার আগেই গ্রেনেড হামলায় পুরো এলাকা রূপ নেয় মৃত্যুপুরীতে।
ওই হামলার যেসব ছবি বহুল প্রচারিত তার মধ্যে একটিতে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানকে দেখা যায়। তার পাশেই অচেতনভাবে পড়েছিলেন নীল পেড়ে হালকা কমলা রঙের শাড়ি পরা মাহবুবা। সবাই ভেবেছিলো তিনি মৃত। মৃত ভেবেই ফেলে রাখা হয়েছিলো তাকে। এরপর তাকে উদ্ধার করে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। মরদেহ শনাক্ত করতে গিয়ে তাকে জীবিত দেখতে পান স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আশিষ কুমার মজুমদার। এরপর তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ৭২ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরে তার।
সম্প্রতি সাভার বাজার রোডে বাসায় কথা হয় মাহবুবার সঙ্গে। জানান, তিনি গ্রেনেড হামলার এক বছর আগেই সাভার পৌর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের বছর ২০০৪ সালে নির্বাচিত হন বৃহত্তর ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। সেদিন ঢাকায় শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনতে সেখানে যান তিনি।
সেদিনের বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা আপা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলতে পারেননি। তখনই একটা বিকট শব্দ হয়। পুরো এলাকা অন্ধকারে ছেয়ে যায়। তখন আমরা কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম—বাঁচাও, বাঁচাও।”
সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় মাহবুবা বলেন, “গ্রেনেড হামলার সময় মাটিতে শুয়ে পড়েছিলাম। অসংখ্য মানুষ আমার উপর দিয়ে হুড়োহুড়ি করে দৌড়ে গিয়েছিলো। আমি গ্রেনেডবিদ্ধ অবস্থায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়েছিলাম। ডান হাত কনুই থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় অচেতন হয়ে পড়ি। তখন নাকি আমার হার্ট অ্যাটাক হয়। উদ্ধারকারীরা জানতেন না আমি জীবিত। ভ্যানে করে অন্যদের সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে ছিলাম। দুদিন পর জ্ঞান ফেরে। তবে স্বামী-সন্তান কাউকেই চিনতে পারিনি। ২৫ দিন পর স্মৃতিশক্তি ফেরে। দেশে চিকিৎসার পর কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। এরপর জানতে পারি শরীর জুড়ে ১,৮০০ স্প্লিন্টারের কথা। পরে তিনটি স্প্লিন্টার বের করা হয়েছে।”
মাহবুবা বলেন, ‘শরীরের স্প্লিন্টারগুলো সব সময় খোঁচায়, সুইয়ের মতো হুল ফোটায়। বাতাস না পেলে আরও যন্ত্রণা হয়। ১৯ বছর ধরে এই ভার বহন করে চলছি, আর পারি না।”
মাহবুবা বলেন, “পাঁচ বছর হুইলচেয়ারে আর আট বছর ক্রাচে ভর করে হাঁটার পর এখন অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটতে পারি।”
মাহবুবা বলেন, “একেক দিন একেক উপসর্গ। জ্বালা-যন্ত্রণা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। তবে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। ঘুম থেকে উঠে শরীরের যেসব জায়গায় স্প্লিন্টার সেখানে চুলকায়, ব্যথা করে সেসব স্থানে ম্যাসাজ করে দিতো আমার স্বামী। এখন তিনি নেই, তাই যন্ত্রণা হলেও ম্যাসাজ করার কেউ নেই।”
মাহবুবা পারভীন বর্তমানে ঢাকা জেলা (উত্তর) স্বেচ্ছাসেবক লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছাকাছি যেতে চেয়েছিলেন, পেরেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে খুব আদর করেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে রাজধানীর মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট দিয়েছেন, চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে জনতা ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা। সেই টাকা দিয়ে বাবার দেওয়া জমিতে একটি দোতলা বাড়ি নির্মাণ করে সেখানেই থাকেন।
শারীরিক অশান্তির মধ্যে রাজনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে মানসিক অশান্তির মধ্যে আছেন মাহবুবা। তিনি বলেন, “রাজনীতির জন্য আজ তার এ অবস্থা। অথচ সাভার পৌর আওয়ামী লীগের কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হয় না। নিজে কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও তাকে মঞ্চে ডাকা হয় না।”
রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেতে একটি গাড়ি কিনতে চান তিনি। মাহবুবা বলেন, “নিজের কিডনি বিক্রি করে হলেও রাজনীতির মাঠে সক্রিয়ভাবে কাজ করার জন্য গাড়ি কিনবো। আমি রাজনীতি ছাড়া চলতে পারি না। মিটিং মিছিলে না গেলে ঘরের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার অবস্থা হয়।”
এজন্য একটি একটি গাড়ির ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।