রুবেল মজুমদার: ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই যেমন শতশত মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন। কেউ গন্তব্যে ফিরেছেন, কেউ বা গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্টেশন ত্যাগ করছেন। ঠিক একইভাবে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে একটু আশ্রয়ের সন্ধানে লড়াই শুরু হয় কুমিল্লার হাজার খানিক ভাসমান ছিন্নমূল নারী-পুরুষ ও শিশুদের।
প্রতিদিন তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পেপার আর পলিথিন বিছিয়ে একটু শোয়ার জায়গা করে নিতে ব্যস্ত তারা। রাত গভীর হতেই খেয়ে না খেয়ে কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, আবার কারো কাটে নির্ঘুম রাত। আর এভাবেই কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের ভাসমানদের আশ্রম বা আশ্রয়স্থল।
বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) রাত ১২ টায় সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশনের প্রবেশ মুখে সারি সারি মানুষ শুয়ে আছে। কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেউ ঘুমের মধ্যে মশা তাড়াচ্ছেন আবার কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করছেন।
আর এই ছিন্নমূল ভাসমান মানুষদের মধ্যে অনেকে শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছেন। কেউ কুলি মজুরের কাজ করেন, কেউ টোকাই আবার কেউ হকার। কিন্তু নেই তাদের নিরাপদ বাসস্থান। যেখানেই রাত হয় তারা সেখানেই গা এলিয়ে একটু বিশ্রাম করেন বা ঘুমিয়ে যান। এভাবেই চলতে থাকে দিন মাস বছর। তাদের দেখার যেন কেউ নেই। অনেক ভূমিহীন মানুষ সরকারি সহযোগিতা, আশ্রয়ণের ঘর পাওয়ার আশায় দিন গুণে। কিন্তু, তাদের এই আশাকে পুঁজি করেই ঘর দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে চাঁদা আদায় করে নেয় একটি মহল।
কথা হয়, রেলওয়ে স্টেশনের ভাসমানদের একজন ৭৫ বছর বয়সী ওহেদা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, বহু বছর ধরেই স্টেশনে রাতদিন পার করছি। মানুষের কাছে হাত পাতি, এভাবেই আল্লাহ দিন চালিয়ে নিচ্ছে। আমাদের দেখার কেউ নাই, সরকারের দিকে তাকাই আছি।
ওহেদা বেগমের কথার সাথে তাল মিলিয়ে একই কথা বলেন, মেহেরা বেগম ও পারভীন বেগম। তাদেরও এই দুনিয়ায় কেউ নাই। স্টেশনেই দিনাতিপাত করছেন তারা।
এখানে থাকা আকলিমা আকতার (২৫) বলেন, আমাদের থাকার জায়গা নাই। আমাদেরকে সরকারি থাকার জায়গা দিবে বলে বিভিন্ন লোকেরা আমাদের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা করে নিয়েও গেছে। কিন্তু তাদেরকে আর পাইনি। আরেকবার সেনাবাহিনীর নাম নিয়ে আসছিলো একটা দল। তারা আমাদের কাছে ৩ হাজার টাকা করে চেয়েছিলো, কিন্তু আমরা আগেরবারের ধোঁকা খেয়ে পরে আর টাকা দিইনি।
মনোরা বেগম (৫৫) বলেন, বাড়িঘর নাই, মেয়েদেরকে বিয়ে দিছি। আমি এখন একা। ছেলে যেখানে কাজ করে সেখানে থাকে। আমার দেখার কেউ নাই। সরকার যদি আমার একটা থাকার ব্যবস্থা করে দিতো, তাহলে অনেক উপকার হইতো। দুই হাত তুইলা আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম।
শুধু ওহেদা, আকলিমারাই নয়, এখানকার প্রতিটি ছিন্নমূল মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক একটি জীবন্ত আখ্যান। এমন অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুমিল্লার টাউনহলের পাশে, বিভিন্ন ফুটপাত ও বাসস্ট্যান্ডসহ পথের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। তাদের নেই কোনো জীবনের নিশ্চয়তা। নেই নাগরিক সুযোগ সুবিধা। দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে এসব মানুষের লাইন।
কুমিল্লা রেলওয়েতে কর্মরত এক নিরাপত্তা কর্মী বলেন, রাত হলেই এখানে ভিড় লেগে যায়। কে কার আগে জায়গা দখল করবে এটা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, আমি এই বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আর কে বা কারা সরকারি সহযোগিতা দিবে বলে চাঁদা আদায় করে এই বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিবো।