শাহরিয়ার আলম: রাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে লোকজনের আনাগোনা বন্ধ হয়ে যায়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয় শহর। তখন ফাঁকা শহরে কাজ শুরু হয় জিতেন দাসের। চলে ভোর পর্যন্ত।
ঝড়-বৃষ্টি যা-ই হোক, শহরের একপ্রান্ত থেকে তিনি শুরু করেন পলিথিন ও মোটা কাগজ বোতলসহ সব ধরনের প্লাস্টিকের টুকরো কুড়ানোর কাজ। সারারাত জেগে কুড়ানো শেষে ভোরে সেগুলো নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পরে ভাঙ্গারির দোকানে সেগুলো বিক্রি করেন। এভাবে ২ যুগেরও বেশি সময় দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে আছেন।
জিতেন দাস ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌর এলাকার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে বসবাস করেন। একটু গভীর রাতে শহরে রাস্তায় বের হলেই দেখা মেলে তার সঙ্গে। শহরবাসীর কাছে তিনি ২৫ বছর ধরে রাতের স্বাক্ষী হিসেবে পরিচিত।
জিতেন দাস জানান, অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্ম তার। বাবা তারাপদ দাস পরের ক্ষেতে কামলার কাজ করে সংসার চালাতেন। ছোটবেলা থেকেই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটতো তাদের। তাই কৈশোরে কাজের সন্ধানে শহরে চলে আসেন। এখন তার বয়স ৬৯ বছর। কমল ও কৃষ্ণ দাস নামে ২ ছেলে থাকলেও পৃথক সংসারে তারাই চলতে পারে না। একমাত্র মেয়ে সম্পা দাসকেও বিয়ে দিয়েছেন। অসুস্থ শরীর হলেও বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী সুমিত্রা দাসকে নিয়ে শুধু খেয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধে আছেন।
তিনি জানান, প্রথম দিকে গভীর রাতে শহরের সড়কে বের হলে প্রশাসন ও নৈশপ্রহরীরা নানা প্রশ্ন করতো। এখন তারা নৈশপ্রহরীদের একজন মনে করেন।
তিনি বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি হওয়া জিনিসপত্রের মোড়কে থাকা পলিথিন, মোটা কাগজ, প্লাস্টিকের বোতলসহ বিভিন্ন ফেলনার টুকরো সারাদিন সড়কের পাশে ফেলে রাখে। যা সকাল হলেই পরিচ্ছন্নকর্মীরা ময়লার স্তুপে ফেলে দেবে। তার আগেই এগুলো কুড়িয়ে তা বিক্রির মাধ্যমে সংসার চালাচ্ছেন।
জিতেন দাস বলেন, রাতভর জেগে থাকার কাজটি অত্যন্ত কঠিন তারপরও দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে তাকে এ কাজ করতে হয়। এখন বৃদ্ধ বয়সে এসে অন্য কাজ করতে পারেন না। যতদিন শরীর চলে ততদিন এ কাজ করেই যাবেন।
তিনি জানান, শহরের সড়কে বর্জ্যাদি কুড়িয়ে বড় বড় বস্তায় ভরে শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে জড়ো করেন। পরে ভোর হলেই সেগুলো নিয়ে বাসার পাশে জমা করেন। পরে সেগুলো প্রতিকেজি সাড়ে ১২ থেকে ১৪ টাকায় বিক্রি করেন। তা দিয়ে স্ত্রী সুমিত্রা দাসকে নিয়ে দুইজনের সংসার চালান।
প্রতিবেশি জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, জিতেন দাস তাদের মহল্লায় একটি মেহগনি বাগানের জমি মাসে ২শ’ টাকায় ভাড়ায় সেখানে ঝুঁপড়ি বেঁধে অনেক দিন ধরে বসবাস করছেন। বয়সের ভারে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত তিনি, তারপরও প্রতি রাতেই বের হন শহর কুড়াতে। বৃদ্ধ বয়সে এমন কষ্ট করলেও আশপাশের মানুষের কাছে হাত পাতেন না তিনি।
কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম জানান, জিতেন দাস রাতে শহরের বিভিন্ন সড়কে পলিথিন, প্লাস্টিক ও ভাঙ্গারি সামগ্রী খুঁজে বেড়ান। তার নিজের মহল্লাতেই থাকেন। চলাচলের স্বচ্ছতার জন্য তাকে একটা বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ভোরে শহর পরিস্কারের জন্য কাজ করেন। কিন্ত তার আগেই জিতেন দাস গভীর রাতে শহরের প্রাণকেন্দ্রের সড়ক ও অলিগলিতে পড়ে থাকা ভাঙ্গারি সামগ্রী কুড়িয়ে তাদের কিছুটা হলেও উপকার করে থাকেন। এক কথায় লাগাতার রাত জাগা কাজ যত কঠিনই হোক না কেন বছরের পর বছর এ কাজ করে চলেছেন। কোন কাজই ছোট নয়, ফলে তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।