বরেন্দ্র অঞ্চলে বিপজ্জনক রাসেল ভাইপার, কামড়ে মারা যাচ্ছে ৯০ ভাগ রোগী

দীর্ঘ ২৫ বছর বরেন্দ্র অঞ্চলে সাপটির দেখা মেলেনি। তারপর ২০১৩ সালে প্রথম সাপটির দেখা মেলে। গবেষকেরা তখন জানান, পদ্মা নদী হয়ে বানের পানিতে ভেসে ভারত থেকে এ দেশে ঢুকছে রাসেল ভাইপার নামের এই সাপ। এরপর গত ১০ বছরে সাপটি পদ্মা নদীপাড়ের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, এই সাপে কাটা রোগীদের ৯০ ভাগই মারা যাচ্ছে। এই সাপটি রাজশাহী অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘চন্দ্রবোড়া’ বা ‘আইলবোড়া’ নামে পরিচিত।

চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, রাসেল ভাইপার সাপটি নিরীহ। তবে অত্যন্ত বিপজ্জনক। এ সাপে কাটলে তিন-চারদিন পর্যন্ত কোনো ব্যাথা কিংবা জ্বালা-পোড়া থাকে না। তারপর দংশিত স্থান ফোলা শুরু হয়। এরপর খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। শেষে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে রোগী মারা যায়।

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে এখন নিয়মিতই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এই সাপে কাটা রোগী আসছেন। এছাড়া কমন ক্রেইট বা কালাচ নামের আরেকটি সাপে কাটা রোগী আসছেন নিয়মিত। বর্ষাকালে কমন ক্রেইটে কাটা রোগীর সংখ্যা হচ্ছে বেশি। আর গ্রীষ্মে বেশি হচ্ছে রাসেল ভাইপারে কাটা রোগী। এ অঞ্চলে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ বলছেন, পদ্মা নদীপাড়ের জেলাগুলোতে সাপের উপদ্রব বেশি। তাই এ অঞ্চলে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যাও বেশি। এ জন্য দেশের অন্যান্য সদর হাসপাতাল কিংবা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেয়ে এখানে সাপে কাটা রোগী আসে বেশি। সচেতনতার অভাবে সাপে কাটার ঘটনা যেমন কমছে না তেমনি মানুষের মৃত্যুও কমানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন তিনি।

হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, এ অঞ্চলে রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেশি দেখা যায় গ্রীষ্মকালে। আর বর্ষকালে বেশি উপদ্রব হয় কোবরা এবং কালাচ বা কমন ক্রেইটের। বাড়ির আশপাশে পানি ঢুকে পড়লে এরা বসতবাড়িতে ঢুকে কামড় দেয়। কমন ক্রেইটে কাটা রোগীর শ্বাসকষ্ট না হলে এন্টিভেনমের প্রয়োজনই নেই। তবে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। ৩৬ ঘণ্টা পর এমনিতেই শরীরের এন্টিবডি এই সাপের বিষকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে পারে। তবে কোবরা ও রাসেল ভাইপারে কাটলে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোগীর শরীরে এন্টিভেনম প্রয়োগ করতে হয়।

হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখানে সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫৫৮ জন। এদের মধ্যে বিষধর সাপে কাটা রোগী ১০৮ জন। এরমধ্যে কমন ক্রেইটে কেটেছে ২৩ জনকে। আর রাসেল ভাইপারে কেটেছিলো ২৫ জনকে। বাকি রোগীদের কাটে অন্যান্য বিষধর সাপে। এসব রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয় রাসেল ভাইপারে কাটা রোগীদের ক্ষেত্রে। এ বছর বিষধর নয় এমন সাপে কাটা রোগী আসেন ৪৫০ জন। চলতি বছরে হাসপাতালে আসা মোট ৫৫৮ রোগীর মধ্যে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সোমবার দুপুরে রামেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) গিয়ে দেখা যায়, ফটিক আলী (৭০) নামের এক রোগীকে আইসিইউ থেকে কিডনি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ফটিকের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলায়। গত শনিবার জমিতে নিড়ানি দেওয়ার সময় রাসেল ভাইপারে কেটেছে তাকে। রোগীর শ্যালক সেতাউর রহমান জানালেন, সাপে কাটার পর ফটিক সাপটিকে দেখেন। তাই তারা রোগীকে দ্রুত সময়ের মধ্যেই হাসপাতালে আনেন। এখানে আসার পর তিন দিনে মোট ৬০ ভায়াল এন্টিভেনম দিতে হয়েছে রোগীকে। তারপরও বিষক্রিয়ায় রোগীর কিডনির কার্যক্ষমতা কমে গেছে। তাই ডায়ালাইসিস দিতে রোগীকে কিডনি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

২৫ বছর পর এই নাচোল উপজেলাতেই ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো রাসেল ভাইপার সাপের দেখা মেলে। আনোয়ার হোসেন নামের পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া এক কিশোর স্কুল যাবার পথে সাপটিকে রাস্তার ধারে মাথা তুলে বসে থাকতে দেখে। ওই কিশোর সাপের কাছে যায়, কিন্তু সাপটি নড়াচড়া করছিল না। তখন আনোয়ার সাপটির গলা চেপে ধরে। এ সময় আনোয়ারের হাতে কামড় দেয় সাপ। পরে সাপসহ আনোয়ারকে আনা হয় রামেক হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা সাপ দেখে জানান, এটি ২৫ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া রাসেল ভাইপার। সাপের কামড়ে আনোয়ারেরও কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। এর ২২ দিন পর সে মারা যায়।

রামেক হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলছেন, রাসেল ভাইপারে কাটা রোগীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মারা যায়। যেসব রোগীদের ক্ষেত্রে কাটার সময় সাপ অল্প বিষ ঢেলেছে কিংবা দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে আনা হয়েছে কেবল তাদেরই বাঁচানো গেছে।

তিনি বলেন, এই সাপ কাটার স্থান ফুলে গিয়ে পচন দেখা দেয়। এরপর কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। শ্বাসকষ্ট হয়ে রোগী মারা যায়। তবে কাটার দুই ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনলে রোগীকে বাঁচানো যায়। এই হাসপাতালে আসা রোগীদের সুস্থ করতে কাউকে কাউকে ১০০ ভায়াল পর্যন্ত এন্টিভেনম দিতে হয়েছে। এর দাম এক লাখ টাকারও বেশি।

রোগীকে বাঁচাতে হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা এবং দুই ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে আনা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাপে কাটলে এখনও মানুষ ওঝার কাছে যায়। কিন্তু ওঝাকে সাপে কাটলে সে নিজেই হাসপাতালে আসে। তাই মানুষকে বুঝতে হবে, ওঝা কখনও বিষ নামাতে পারে না। নির্বিষ সাপে কাটলে রোগীর মৃত্যু হয় না বলে তারা এর সুযোগ নেন। সাপে কাটা রোগীর মৃত্যু কমাতে হলে রোগীকে ২ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আনতে হবে এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও এন্টিভেনম থাকতে হবে। পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রোগীকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, রাসেল ভাইপার আরেকটি কারণে বিপজ্জনক, তা হচ্ছে কাটার পর তিন-চারদিন পর্যন্ত বোঝাই যায় না। যখন দংশিত স্থান ফুলতে শুরু করে তখন বোঝা যায়। সাপে কাটার বিষয়টি রোগী বুঝতে বুঝতেই সময় চলে যায়। ভয়ংকর এই সাপের শিকার হচ্ছে পদ্মাপাড়ের জেলাগুলোর কৃষকেরা। এ জন্য কৃষকদের সচেতন করতে হবে যেন কাজ করার সময় তারা গামবুট পরে থাকেন। তাহলে সাপে কাটার ঝুঁকি অনেকটা কমবে। এ জন্য কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেশি বলে কৃষকদের প্রায়ই সচেতন করা হয়। তারা মাঠে গেলে যেন গামবুট ব্যবহার করেন সেটি বলা হয়। অনেকে এখন ব্যবহার করছেন, কিন্তু সবাই না।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts