আশিতম জন্মদিনের শুভেচ্ছা ll প্রবীণ জ্ঞানবৃক্ষ সৈয়দ আকরম হোসেন স্যার

প্রত্যয় জসীম

সৈয়দ আকরম হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। অধ্যাপক পদ থেকে ২০১১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এখনো তিনি সুপারনিউমারারি প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রবীন্দ্র কথাসাহিত্য নিয়ে গবেষণা করলেও তাঁর জ্ঞানের পরিধি রবীন্দ্রচর্চায় সীমাবদ্ধ নয়। একটি উদার আধুনিক অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য সাংস্কৃতিক প্রেরণায় উদ্ভাসিত তাঁর চেতনালোক।

সৈয়দ আকরম হোসেন ৮ ডিসেম্বর ১৯৪৪ সালে বৃহত্তর যশোর জেলার কালীগঞ্জ থানার গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতা-মাতার তৃতীয় ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। পিতার নাম সৈয়দ আবুল কাশেম, তিনি চাকরিজীবী ছিলেন। মায়ের নাম মোসাম্মৎ হাসিনা খাতুন, মাতা গৃহিনী ছিলেন। বড় ভাই সৈয়দ আফজল হোসেন, একমাত্র বোন ফাতেমা খাতুন রুবী। পিতার চাকরির সুবাদে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের একটা বড় সময়ই কেটেছে যশোর শহরে।

সৈয়দ আকরম হোসেন যশোরের সম্মিলনী বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৬২ সালে যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৬৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। এই বিভাগ থেকেই ১৯৬৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

শিক্ষাজীবনে পেয়েছেন অসামান্য সব শিক্ষক। বাঙালির সম্মিলিত সৃজনশীলতা যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন সেইসব মহান শিক্ষকদের ছায়ায় বেড়ে ওঠেছেন সৈয়দ আকরম হোসেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম, অধ্যাপক আহমদ শরীফ, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রমুখ শিক্ষকদের স্নেহছায়ায় বেড়ে ওঠা সৈয়দ আকরম হোসেন নিজেও আজ প্রাচীন জ্ঞানবৃক্ষ।

তাঁর প্রকাশিত গবেষণা গ্রন্থ সমূহ:- ‘রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস: দেশকাল ও শিল্পরূপ’, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৬৯। ‘রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস: চেতনালোক ও শিল্পরূপ’, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৮১। ‘বাংলাদেশের সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫। ‘এস ওয়াজেদ আলী’, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৬। ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৮। ‘আবদুর রাজ্জাক’, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৯০। ‘প্রসঙ্গ: বাংলা কথাসাহিত্য’, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৭।

সংগ্রহ ও সম্পাদিত বই সমূহ:- ‘মুনীর চৌধুরী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আনোয়ার পাশা’, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৭২। ‘এস ওয়াজেদ আলী রচনাবলী’ [প্রথম খন্ড], বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫। ‘এস ওয়াজেদ আলী রচনাবলী’ [দ্বিতীয় খন্ড], বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫। ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনাবলী [প্রথম খন্ড], বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৬। ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনাবলী [দ্বিতীয় খন্ড], বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৭। ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী, [১-৩০ খন্ড], ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০১৬।

দুর্লভ গ্রন্থ সংগ্রহ ও সম্পাদনা:-‘আহৃতি’ [প্রবন্ধ], নরেশ সেনগুপ্ত, ধ্রুবপদ, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১০। ‘অগ্নি-সংস্কার’ [উপন্যাস], নরেশ সেনগুপ্ত, ধ্রুবপদ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১১।

সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও রয়েছে তাঁর অবদান মোট ১৩ বছর (১৯৭৮-১৯৯১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। সৃজনশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘উলুখাগড়া’-র সম্পাদন করছেন।

একাডেমিক জ্ঞানচর্চায় রবীন্দ্র পরিসরের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে তিনি সাহিত্যের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে নিজেকে সঞ্চারিত করেছেন। তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করেছেন রবীন্দ্র চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত চেতনালোকে। গত শতাব্দির ত্রিশের দশকের মুক্তবুদ্ধি চর্চার অন্যতম পুরোহিত এস ওয়াজেদ আলী ও কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহকে নিয়ে কাজ করেছেন। এখানেই সৈয়দ আকরম হোসেন তাঁর মৌল চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। রবীন্দ্র পরিসরের বাইরে সামগ্রিক মানবমুক্তির দিকে তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করেছেন।

কর্মজীবনে তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭২ সালে সহকারী অধ্যাপক, ১৯৭৮ সালে সহযোগী অধ্যাপক, ১৯৮৪ সালে অধ্যাপক হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে একই বিভাগে সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

বাংলা বিভাগে যোগদানের পর তিনি এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার চেয়ে দায়িত্বটাকে বিশেষভাবে গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলা বিভাগ যখন শিক্ষক সংকট সহ নানা সমস্যায় পতিত হয় তিনি তা সমাধানের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন। তিনি ছাত্র-বান্ধব শিক্ষক হিসেবে পরিগণিত হন। শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন না, একইসাথে ক্লাসের পর বিকেলে বা নানাসময়ে তাঁর নিজ বাসাতে সাহিত্য বিষয়ক নানা আড্ডার আয়োজন করতেন। শিক্ষার্থীদের নানান বিষয়ে পরামর্শ শিক্ষামূলক নির্দেশনা দিতেন।

সৈয়দ আকরম হোসেন ১৯৬৮ সালে মোসাম্মৎ উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই ছেলে: সৈয়দ আজফর হোসেন ও সৈয়দ আরমান হোসেন। বড় ছেলে শিক্ষকতায় আছেন। ছোট ছেলেও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। ছোট ছেলে সৈয়দ আরমান হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।

সৈয়দ আকরম হোসেন গবেষণার জন্য ১৯৮৯ সালে “বাংলা একাডেমি” পুরস্কার লাভ করেন এবং বাংলা একাডেমির ‘ফেলো’ নির্বাচিত হন। রবীন্দ্র সাহিত্যের-চর্চা ও গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে পেয়েছেন “বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-পুরস্কার ২০১৬”। গবেষণা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৭ সালে “একুশে পদক” লাভ করেন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট ২০১৮ সালে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেনকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত করেছে।

বয়সে প্রবীণ হলেও কর্ম চঞ্চলতায় তিনি এখনো যুবক। এখনো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশে নিরন্তর ক্রিয়াশিল। আট ডিসেম্বর তাঁর শুভ জন্মদিন। তিনি শত আয়ু হবেন এই প্রত্যাশা করছি। আমার অকাল প্রয়াত স্ত্রী ড. স্বাতী জসীম সৈয়দ আকরম হোসেন স্যারের ছাত্রী ছিলেন। তাঁর মুখে স্যারের অনেক প্রশংসা শুনেছি। তিনি আমার প্রথাগত শিক্ষক না হলেও শিক্ষক তুল্য। আশিতম জন্মদিনে এই মহান ও মহৎ শিক্ষকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

প্রত্যয় জসীম : কবি ও সব্যসাচী লেখক
সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ফাউন্ডেশন

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts