ইবনে জালাল
কবি ফকির ইলিয়াস সমকালীন কবিদের মাঝে উল্লেখযোগ্য নাম। গদ্য, পদ্য, কথাসাহিত্য, সাহিত্য সমালোচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। নিয়মিত কলাম লিখেন জাতীয় নিউজ মিডিয়ায়। প্রধানত তিনি কবি।
তিনি লিখেন-
‘এই পৃথিবী কোনোদিনই ভুখা মানুষের ছিল না,
যারা নাঙ্গা, যারা গৃহহীন
তারা কোনোদিনই জানাতে চায়নি নিজেদের পরিচয়’
….. বলতে বলতে একটি চাঁদ দক্ষিণে ডুবে যায়!
আরেকটি চাঁদ আগামীকালের আকাশে হাজিরা
দেবে বলে, নিজের অস্তিত্ব খুঁজে। রাত ঘন হয়ে
নুয়ে পড়ে শীতের বিছানায়। পৌষের পিপাসা;
বুকে নিয়ে একা জেগে থাকে মুমূর্ষু গন্ধরাজ !
মাটি ঘামের গন্ধ ভালোবাসে। আর হাওয়া ভালোবাসে,
গোলাপের বিচিত্র কিরণ। যারা মায়ামন্ত্র শিখে
কল্যাণের ধ্যানে দুপুর যাপন করে-
শুধু তাদের জন্যেই,
আকাশ শিখে মৌলিক বরাদ্দবিদ্যা।
যদি উচ্চতার কথা বলি, জগতে-
পাহাড়ের চূড়ার চেয়েও উঁচু, বেদীর নাম
মানুষের মন!
আর সেখানেই থাকে সৃষ্টির সর্বোচ্চ মায়াপাহাড়।
আমি তোমাকে সেই মায়াপাহাড়টুকুই
লিখে দিয়ে যেতে চাই!
উত্তরে এসো!
দক্ষিণে কেবলই সমুদ্র,
ঢেউ আর গর্জনের বিষণ্ণ বিকেল !
এমন চমৎকার পংক্তিমালা যার হাতে লেখা হয় তিনি এই সময়ের উজ্জ্বল কবি ফকির ইলিয়াস। ২৮ ডিসেম্বর এই নান্দনিক কবির জন্মদিন। । ১৯৬২ সালের এই দিনে তিনি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। ফকির ইলিয়াস লিখে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। তাঁর লেখা প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা -২৫। শক্তিমান এ কবির কবিতায় উঠে আসে আমাদের জীবন ও প্রেমের ছাপচিত্র।
তিনি লিখেন-
প্রথম পর্বটি লেখা হয়ে ওঠে’নি।এমন কি
দ্বিতীয় পর্বও। ক্ষেতে যে রাত্রি জেগে থাকে-
বাগানে প্রহরী হয়ে থাকে যে ফুল-
লেখা হয়’নি কারোই বেদনার কাহিনি। দেখা
হয়নি কারোই সম্ভাব্য রাত পোড়াবার দৃশ্যাবলি।
অথচ বনময়ুরের পায়ে পায়ে হেঁটেই পাড়ি
দেয়া হলো এই বনপ্রান্তর। এখানে বসন্ত কোনোদিন
পেখম মেলবে না জেনেই
সাজানো হলো পাপড়িসমাবেশ।
আর যে সিঁড়ির গল্প তোমাকে শোনাবো বলে
জমিয়েছিলাম, কয়েকটি কাঠের টুকরো তা উড়িয়ে
নিয়ে গেল বসন্তের ঝড়;
অথচ তুমিই তো বলেছিলে ফালগুণের
বৃষ্টিতে শুধুই পাপড়ি বর্ষিত হয় !
প্রবাসে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি,কৃষ্টি- লালন ও চর্চায় তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ- ‘বঙ্গবন্ধুর জ্যোতিরেখায় শেখ হাসিনা’ ২০২৩ এর ঢাকা একুশে বইমেলায় ছিল একটি আলোচিত গ্রন্থ। এছাড়াও ‘মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্র ও স্বাধীনতার উত্তরাধিকার’ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস ‘মেঘাহত চন্দ্রের প্রকার’- গ্রন্থ দুটিতে তিনি দক্ষতার সাথে বর্ণনা করেছেন বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামের চাওয়া-পাওয়া। কবি ফকির ইলিয়াসের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’-য় স্থান পেয়েছে বেশ কিছু কবিতা, যা সমকালে বেঁচে থাকবে মানুষের প্রাণে প্রাণে। তাঁর কবিতা আমাদের সম্মোহিত করে রাখে।
”প্রতিদিন আমার সাথে ভ্রমণে বেরোয়
বাংলার যে পাখি,তার বয়স বাড়ে না।
প্রতিরাতে আমাকে পাহারা দেয় বাংলার
যে জোনাকি,তার যৌবন স্থির থেকে যায়।
কিংবা এই যে নদী তুমি দেখছ-
তার প্রবাহ তোমার হাতের দশটি আঙুলের
মতো-
যে হাত দুটিতে চুমু খেতে খেতে আমি
ঘুমিয়ে পড়ি কবিতার নিমগ্ন বিভায়।
পৃথিবীর জন্মদিন বলতে আমি
ষোলই ডিসেম্বরকে বুঝি
লাল বলতে বুঝি আমার রক্তের রঙ
আর যে সবুজে দাঁড়িয়ে তুমি-আমি
দেখি হাওয়ার উদ্দাম নৃত্য-
মূলত সেটাই আমাদের প্রেমের সংবিধান!
পর্যটন কখনও সীমান্ত মানে না।
ভালোবাসাও মানে না শাসনতন্ত্র।
মানব-মানবী;
সারিবদ্ধ হলেই তৈরি হয় সূর্যের প্রথম রেখা।”
এমন অনেক প্রাঞ্জল পংক্তির জনক তিনি। মরমীধারার সহস্রাধিক গানের পদকর্তা হিসেবেও তিনি রেখেছেন উজ্জ্বলতার সাক্ষর।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থর মধ্যে রয়েছে- কবিতার বিভাসূত্র (প্রবন্ধ- ২০০৯), চৈতন্যের চাষকথা (গল্প-২০১০), গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ (কবিতা-২০১১), ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম (কবিতা-২০১২), গৃহীত গ্রাফগদ্য (কবিতা-২০১৪), অনির্বাচিত কবিতা (কবিতা-২০১৫), সাহিত্যের শিল্পঋণ (প্রবন্ধ-২০১৬)। মুক্তিযুদ্ধের মানচিত্র ও স্বাধীনতার উত্তরাধিকার (প্রবন্ধ-২০১৭) মেঘাহত চন্দ্রের প্রকার (উপন্যাস-২০১৭), শহীদ কাদরী’র দরবারের দ্যুতি (প্রবন্ধ-২০১৮) , প্যারিস সিরিজ ও অন্যান্য কবিতা (কবিতা-২০১৮), নক্ষত্র বিক্রির রাতে (কবিতা-২০১৯), সম্মোহিত শব্দদাগ (প্রবন্ধ-২০১৯), গ্রহান্ধ ঘরের কাহিনি (কবিতা-২০১৯), ধানমণ্ডির ধ্বনিপুত্র ( কবিতা- ২০২০) ইত্যাদি।
সহধর্মিনী কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি ও দুকন্যা নাহিয়ান ইলিয়াস ও নাশরাত ইলিয়াসকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে বাস করেন নিউইয়র্কে।