লাল পলাশে শিমুল বন ভালোবাসায় হারায় মন

অলোক আচার্য

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে বসন্তের প্রথম দিনকে বেছে নেওয়ায় বাঙালির প্রাণে থাকে উচ্ছাস, আনন্দ। যদিও ভালোবাসতে কোনো নির্দিষ্ট দিন ক্ষণ প্রয়োজন হয় না, তবু এই দিনকে ঘিরে উচ্ছাস থাকে। প্রেমিক যুগল অপেক্ষা করে। ’ভালোবাসা” শব্দটি মূলত এতটাই বিস্তৃত যে কোনো নির্দিষ্ট দিনে তাকে বেধে রাখা সম্ভব না। আবার কোনো নির্দিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। তা যেমন মানুষের সাথে মানুষের তেমনি হতে পারে কোনো প্রাণীর প্রতিও। ভালোবাসার ধরণই এমন। কে কখন কোথায় কাকে ভালোবাসবে তার পূর্ব অনুমান করা সম্ভব না। ভালোবাসার শুরু কবে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না। তবে ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে এর উৎপত্তি নিয়ে দু’একটি তথ্য রয়েছে।

ভ্যালেন্টাইনস ডে’র সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে জানা যায়, রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস একটা সময় তার দেশে বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু তা কি আর আটকে রাখা যায়। এগিয়ে এলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি তরুণ তরুণীদের বিয়ে দিলেন। এভাবে চলতে গিয়ে অবশেষে ধরা পরলেন সম্রাটের হাতে। বন্দী অবস্থায় তার সাথে সম্পর্ক হয় একটি মেয়ের। যে মেয়েটি প্রথমে অন্ধ ছিল বলে জানা যায়। কারাগারে থাকা অবস্থায় তাদের প্রেম হয়। পরবর্তীতে তিনি ধর্মযাজকের আইন ভেঙে মেয়েটিকে বিয়ে করেন বলেও শোনা যায়। এই খবর সম্রাটের কানে যাওয়া মাত্রই তার ফাঁসির রায় হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে তার প্রেমিকার কাছে লেখা শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন ’লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন”।

দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পোপ গেলাসিয়াস প্রথম এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৭০০ শতাব্দিতে দিনটিকে জনপ্রিয়ভাবে পালন শুরু করে ব্রিটেন। ভালোবাসা দিবসের পেছনের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে জনপ্রিয় ইতিহাস। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আগে রোজ ডে এবং প্রপোজ ডে থাকে। যদিও ঘটা করে এসব দিবস পালন করা হয় না। তবে ভালোবাসা দিবস সারা বিশ্বেই বেশ ঘটা করেই পালন করা হয়। এক সময় আমরা এসব দিবসের নামই জানতাম না। আজ প্রযুক্তির কল্যাণে তা জানি। যাই হোক, ফাল্গুনের শুরুতে ভালোবাসা দিবসের এই যে প্রথা আজ সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে তা আমরা সঠিকভাবে বুঝতেও পারছি না, পালনও করছি না। ভালোবাসাকে আমরা বন্দী করে দিয়েছি দিবসের মাঝে।

পৃথিবী সৃষ্টির পর মানবসভ্যতা বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রেখেছে যে অদৃশ্য বস্তুটি তা হলো ভালোবাসা। অথচ কতরকমভাবেই এই শব্দটিকে বিশ্লেষণ করা হয়। আর শেষপর্যন্ত তা কেবল ভিন্ন সম্পর্কের আবেগে গিয়ে ঠেকেছে। ভালোবাসা আগেও যেমন ছিল আজও তেমনি আছে। আমরা তা ভুল পথে চালিত করছি। ভালোবাসাকে ঘিরে বৈজ্ঞানিক কত রসায়ন হয়েছে। আসলে কি এই অদৃশ্য বস্তু? যার জন্য মানুষ ছুটছে। মানুষ তো আজ ভালোবাসার কাঙাল। সারা পৃথিবীতে আজ যা কমছে তা হলো ভালোবাসা। হিংসা,বিদ্বেষের চাপে ভালোবাসা তলানিতে ঠেকেছে। আর ভালোবাসা বলতে আমরা যা বুঝতে পারছি বা গা সয়ে নিয়েছি তা তো মোহ। মোহ আর ভালোবাসাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।

আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবস এমন এক সময় আসে যখন প্রকৃতি নিজেই নতুন সাজে সাজতে থাকে। সে নিজেই রঙিন হতে আরম্ভ করে। প্রকৃতি থেকে শীত বিদায় নেবার প্রাক্কালে গাছে গাছে আম, লিচুর মুকুল দেখা দেয়, ফুল ফোটে, ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি চলে প্রকৃতিজুড়ে। ভালোবাসার অর্থ যেন প্রকৃতিই বোঝে সবচেয়ে ভালো। আজ দেশে বিদেশে কত দিবস পালিত হয় তার কোন পরিসংখ্যান নেই। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এসব দিবস ঘটা করে পালন করা হয়। এসব ভালোবাসার জন্যও দিবস দরকার হয়। সেই দিবসে নাাকি ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। দিবস গেলেই ভালোবাসা উধাও। কত আয়োজন হয় তার হিসাব নেই। অথচ কি আশ্চর্য! প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট ভালোবাসার হওয়া উচিত। কিন্তু সেটাকেও আমরা একটা নির্দিষ্ট দিনে বন্দী করে ফেলেছি। নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পালনের মধ্যেও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে।

সময় যত গড়াচ্ছে, ভালোবাসা দিবস পালনের তোড়জোড় ততই বাড়ছে। ফুল বিক্রি বাড়ছে,নতুন সাজে প্রকৃতির চেহারা বদলে যাচ্ছে, প্রেমিক প্রেমিকা ঘুরছে, আনন্দ করছে। আমরা তো চাই এমন সুন্দর থাক বছরজুড়ে। কিন্তু তা থাকছে না। ভাঙছে আর ভাঙছে। ক্ষণিকের এক দিনে এক মুহূর্তে একটি দিবসের মাধ্যমেই শেষ হচ্ছে সেই দৃশ্যের। এটা যদি হয় তাহলে কাকে ভালোবাসা বলবো? ভালোবাসার সংজ্ঞা কি? হৃদয়ের যে আবেগ যা সেই সুদূর অতীতকাল থেকে মানুষে মানুষে একত্রিত করে রেখেছে, মায়ায়-মমতায় ধরে রেখেছে, একজনের বিপদে অন্যজনকে সামনে এনেছে, কারও হাত পরম নিশ্চিন্তে অন্য কারও হাতে ছেড়ে দিয়েছে তাই ভালোবাসা।

আজ কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। যাকে ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করছি, সেই তাকেই পরক্ষণে আবার সন্দেহ করছি-আরও সম্পর্ক আছে বলে অথবা সে আমার সাথে প্রতারণা করতে পারে বলে এই ভালোবাসার গুরুত্ব কতটুকু। যাকে সম্পর্ক বলে গণ্য করছি তা আদৌ সম্পর্ক কি না তা নিয়েই ভাবতে সময় পার হয়ে যাচ্ছে অনেকটা। এক্ষেত্রে সবাই যুগের কথা বলে অজুহাত দেখানো চেষ্টা করেন। কিন্তু এই যুগের দায় আসলে আমাদেরই। আমরাই বিশ্বাস ভাঙতে ভাঙতে যুগটাকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছি যে একটি দিবস ছাড়া ভালোবাসা প্রায় উধাও একটি বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ভালোবাসা দিবসের এই দিনেও কি কারও স্বপ্নের ভালোবাসার অপমৃত্যু ঘটবে না তার কি গ্যারান্টি আছে। হরহামেশাই তো প্রেমিকের সাথে দেখা করতে গিয়ে ধর্ষণ বা গণধর্ষণের মতো জঘণ্য ঘটনাগুলো ঘটছে। ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করেই তো এই নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটছে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনসের কাছ থেকে যে ভালোবাসা দিবস আমরা আজ পালন করছি সেই ভালোবাসা থেকে সমাজ অনেক দূরে সরে গেছে। ভালোবাসা আজ কেবলই লৌকিকতা। অথচ ভালোবাসা অন্তরের বিষয় কোনো লৌকিকতা নয়। কোনোদিন ছিলও না। আমার ভালোবাসা প্রকাশ পাওয়া উচিত আমার কাজে।

ভালোবাসা শব্দটির কোনো সীমারেখা থাকার কথা না থাকলেও আমরা তা একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলেছি। গায়কের সুরে যখন ভেসে ওঠে, সখী ভালোবাসা কারে কয়, সে কি কেবলি যাতনা ময়’- তখন সত্যি জানতে ইচ্ছে করে ভালোবাসা কারে কয়। তা কি আজ সত্যিই অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বের জেরে মানুষের ভেতর থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে? যার ভেতরে ভালোবাসা থাকে না তাকে তো মানুষ বলা যায় না? পশুও কি বলা যায়? কারণ পশুরও তো ভালোবাসা থাকে। চারদিকে এত নির্মমতা, খুনোখুনি, হানাহানি, যুদ্ধাবস্থা, হিংসা, শক্তি প্রদর্শনী এসব দেখে যে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে ভালোবাসা কোথায়? ভালোবাসা মানেই তবে কেবলই আজকের এই লোক দেখানো চাকচিক্যময় জগতের রঙিন সম্পর্ক? এত ক্ষুদ্র আঙ্গিকে ভালোবাসাকে আমরা বেধে ফেলছি? আবার তাও যদি হয় তবে সেখানেও প্রতিনিয়ত এই বিশ্বাস ভাঙার খেলা চলে কেন? যাকে ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করছি সে-ই আমার বিশ্বাস ভাঙার কারণ হচ্ছে। একাধিক সম্পর্ক শব্দটি অচল হতো যদি ভালোবাসা অটুট থাকতো। তাছাড়া ভালোবাসার মতো একটি বিশাল শব্দকে আমরা নিজেদের স্বার্থে আজ ছোট করে রেখেছি। কোনো দিবসে নয় বরং প্রতিটি দিনই আসলে ভালোবাসা দিবস। কারণ ভালোবাসা ছাড়া একটি দিনও অতিবাহিত হওয়া সম্ভব নয়। ভালোবাসা হোক পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রতিটি প্রাণীর জন্য।

ভালোবাসা বিহীন একটি দিনও পৃথিবীর কাটানো সম্ভব নয়। ভালোবাসার বিপরীতে থাকে ঘৃণা। ঘৃণার্ত জীবন নরকের সমান। পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী ভালোবাসার প্রত্যাশা করে। ভালোবাসা আছে বলেই আজও বন্ধন আছে। আর বন্ধন আছে বলেই মানব জাতি টিকে আছে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে। মানুষ পৃথিবীর প্রতিটি জীবকেও ভালোবাসে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে ভালোবাসার রকমে পরিবর্তন এসেছে। সেটা অন্য ব্যাপার। তবু ভালোবাসা আছে। ভালোবাসা থাকবে যতকাল টিকে থাকবে পৃথিবী নামক এই গ্রহ। পরিশেষে ভালোবাসা দিবসে রইলো সবার জন্য ভালোবাসা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, পাবনা।
sopnil.roy@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts