আজ রাতে পালিত হবে পবিত্র ‘শবেবরাত’। মুমিনের জীবনে এ রাতটি খুবই ফজিলতপূর্ণ একটি রাত। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে আমাদের এই উপমহাদেশে শবেবরাত বলা হয়ে থাকে। ফারসি ভাষায় ‘শব’ অর্থ রাত এবং ‘বরাত’ অর্থ মুক্তি। তাই শবেবরাতের অর্থ হচ্ছে, মুক্তির রাত। এই রাতে মহান আল্লাহ তার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে অসংখ্য বান্দা-বান্দীকে ক্ষমা করে থাকেন। এ রাতটি শাবান মাসের মধ্যবর্তী হওয়ায় রাসুলুল্লাহ (স.) একে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ তথা, শাবানের মধ্যরজনী বলে উল্লেখ করেছেন।
রমজান মাস যথার্থভাবে পালনের জন্য দুই মাস আগে থেকেই এর প্রস্তুতি শুরু হয়। এজন্য রজব ও শাবান মাস হচ্ছে রমজানের প্রস্তুতির মাস। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সময়ে রমজান মাস যতই ঘনিয়ে আসত, তা নিয়ে ততই আলোচনা হতো এবং আমলের মাত্রা বেড়ে যেত। নবিজি সাহাবিদের রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলতেন। এজন্য শাবানের মধ্যরজনী থেকে সাহাবিদের আমলে রমজানের পূর্ণ আমেজ এসে যেত। তাই শবেবরাত আমাদের জন্য রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে।
শবেবরাতের মাহাত্ম্য উল্লেখ করে হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে সুনানে তিরমিজির ১ম খণ্ডে ১৫৬ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে কোনো এক রাতে রাত্রিযাপন করছিলাম। একসময় আমি তাকে বিছানায় না পেয়ে মনে করলাম, তিনি হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম। গিয়ে দেখি, নবিজি জান্নাতুল বাকিতে কবরবাসীদের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর নয়নে কাঁদছেন। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন- ‘হে আয়েশা! তুমি কি মনে করো, আল্লাহর রাসুল তোমার ওপর বেইনসাফি করেছেন?’ আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ এমনটি নয়। আমি আপনাকে বিছানায় না পেয়ে ধারণা করেছিলাম, হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। এরপর রাসুল (স.) বললেন, হে আয়েশা! আজকের রাত সম্পর্কে তুমি জেনে রেখ, মহান আল্লাহ এই রাতে দুনিয়ার প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়ে দুনিয়াবাসীর ওপর তার খাস রহমত নাজিল করেন। কাল্ব গোত্রের মেষের গায়ে যত পশম আছে, তার চেয়েও অধিকসংখ্যক বান্দা-বান্দীকে তিনি ক্ষমা করেন।
ইবনে মাজাহ্ শরিফে হজরত আলী (রা.) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন—রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন শাবানের মধ্যরজনী আসবে, তখন তোমরা সে রাতে নামাজ পড়বে, রাত জেগে ইবাদত করবে এবং পরদিন রোজা রাখবে। কেননা সেদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে এসে বান্দাকে এই বলে ডাকতে থাকেন—আছ কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী, যাকে আমি ক্ষমা করব। আছ কি কেউ রিজিক প্রার্থনাকারী, যাকে আমি রিজিক দান করব। আছ কি কেউ বিপদগ্রস্ত, যাকে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার করব। এভাবে সুবহি সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ ঘোষণা দিতে থাকেন।’ হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) সূত্রে ইবনে হিব্বানে অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবি করিম (স.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধশাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া অন্য সবাইকে তিনি ক্ষমা করেন।’
রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, এ মহিমান্বিত রজনীতে বিশেষ যে আমলগুলোর কথা উল্লেখ হয়েছে তাহলো, রাত জেগে নফল ইবাদত করা এবং পরের দিন রোজা রাখা, এটা শবেবরাতের গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত আমল। এ রাতের ইবাদত যেহেতু নফল, তাই নফল নামাজ কত রাকাত পড়তে হবে, তার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। বরং অন্যান্য নফল নামাজের মতো দুই রাকাত বা চার রাকাতের নিয়ত করে সুরা ফাতেহার পর যে কোনো সুরা মিলিয়ে পড়া যায়। নফলের মধ্যে তাওবার নামাজ, সালাতুত তসবিহ এবং তাহাজ্জুদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ রাতে এ নামাজগুলো আদায় করা উত্তম। কুরআন তেলাওয়াত করা, জিকির-আজকার করা, দরূদ শরিফ পড়া এবং অন্যান্য তসবিহ-তাহলিল পাঠের মাধ্যমেও আমরা এ রাতে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করতে পারি। সম্ভব হলে আপনজনদের কবর জিয়ারত করতে যাওয়া এ রাতের একটি সুন্নত আমল। সাধ্য অনুসারে দান-সদকা করা খুবই ফজিলতের কাজ। দানের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়, কেউ মা-বাবা ও আপনজনদের নিয়ত করে কিছু দান করলে তার সওয়াবও আল্লাহ তাদের কবরে পৌঁছে দেন।
শবেবরাতে প্রভুর কাছে অতীত জীবনের পাপের জন্য ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ কামনা করাও আমাদের কর্তব্য। তাই রাসুলুল্লাহ (স.) এ রাতে কেঁদে কেঁদে যেভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন আমাদেরও সেভাবে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশের জন্য, সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণের দোয়া করতে হবে। তবে পবিত্র শবেবরাতে যেমন পালনীয় বিষয় রয়েছে, তেমনি এ রাতে কিছু বর্জনীয় বিষয়ও রয়েছে। এ রাতে আতশবাজি করা, হইহুল্লোড় করা, অহেতুক ঘোরাফেরা করা, গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া একেবারেই কাম্য নয়। ইবাদতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়, এমন কোনো কাজও এ রাতে করা যাবে না। আল্লাহ আমাদের এ রাতের মাহাত্ম্য অনুধাবন করে আমল করার তাওফিক দান করুন এবং তার ক্ষমার চাদরে ঢেকে নিন। আমিন!
শাহ্ সূফী সাইয়্যেদ মাওলানা এনাম উল্লাহ জোহায়ের
আজিমপুর দায়রা শরিফের বর্তমান গদিনশীন পীর