স্বপ্ন, প্রেম ও যৌবনের বসন্ত বিলাস

দ্যুতিময় বুলবুল

সারা বিশ্বে অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, গল্পকার, গীতিকার ও ঔপন্যাসিক বসন্ত নিয়ে লিখেছেন বহু কবিতা, গান, গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস। কারণ, বসন্তকাল মানুষ ও প্রকৃতির তারুণ্য, যৌবন ও নবজীবনের জয়যাত্রা ঘোষণা করে। তাই কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার ও শিল্পীদের রোমান্টিক প্রেরণা ও সৃষ্টি সুখের উল্লাসের অন্যতম উৎস এই বসন্তকাল। এজন্য ঋতুরাজ বসন্ত বাঙালির জীবন ও সাহিত্যে অন্যতম রোমান্টিক ও আনন্দময় সময়।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। আর ঋতুচক্রের পালাবদলে সর্বশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। বাংলায় ফাল্গুন ও চৈত্র (মধ্য ফেব্রুয়ারি-মধ্য এপ্রিল) এই দুই মাস বসন্তকাল। বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ ও প্রকৃতি বসন্তকালে ফিরে পায় নতুন জীবন। এই বসন্ত ঋতু প্রকৃতির এমন এক উপহার, যা আনন্দময় জীবন, তারুণ্য ভরা যৌবন এবং প্রেমময় সুন্দর ও সমৃদ্ধ পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
শুষ্ক, আড়ষ্ট, তীব্র হাড় কাঁপানো শীতে ঝরা পাতার কান্না শেষে, প্রকৃতিতে নতুন আনন্দবার্তা নিয়ে আসে রঙিন বসন্ত। তাই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বসন্তকালে দারুণভাবে উপলব্ধি করা যায়। এ সময় বাংলার আকাশ হয়ে ওঠে সফেদ শুভ্র, নীল ও স্বচ্ছ। বসন্তের দখিনা বাতাস ও ফুলের সুবাসে ভরে যায় বাঙালির মন-প্রাণ।
বসন্ত রাতে শুভ্র ও স্বচ্ছ আকাশে বসে অগণিত তারার মেলা। বন-বাদাড় আর ঝোপ-ঝাড়ে অসংখ্য প্রদীপ জ্বেলে অবিরাম সঙ্গীত গায় জোনাকির দল। শীতে ঝরা পাতার কান্না থামাতে প্রকৃতিতে গাছে গাছে শাখা-প্রশাখায় গজিয়ে ওঠে নতুন কচি সবুজ পাতা।
ফুল বাগানে কিংবা পথে-প্রান্তরে প্রকৃতির গাছে গাছে, ফুলে ফুলে মৌমাছি ও প্রজাপতির আনাগোনা শুরু হয় এই বসন্তে। এ সময় পলাশ, শিমুল, অশোক. মহুয়া, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া সহ নানা রক্তিম ফুল আনন্দবার্তা দিয়ে প্রাণে প্রাণে আবির ছড়ায়। প্রকৃতির রঙ-বেরঙের এই ফুলের মেলা ভরে ওঠে নানা মৌসুমী ফলে।
এই বসন্তে পাখিরা নব আনন্দে চারিদিকে গাইতে থাকে নতুন গান। বসন্তদূত খ্যাত গানের পাখি কোকিল নবপল্লবিত কচি অশ্বত্থ শাখায় বসে মনের সুখে গলা ছেড়ে কুহু কুহু রব তোলে, নবযৌবনে মধুমিলনের প্রত্যাশায়। দোয়েল, পাপিয়াও নব আনন্দে গলা ছেড়ে গান ধরে। প্রকৃতির এই নবরূপ স্মরণ করিয়ে দেয়, বসন্ত এসে গেছে।
শীতের পর, রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-স্পর্শ আর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আসে এই ঋতুরাজ বসন্ত। দখিনা মলয়ে বসন্ত ঋতুর আগমনী বার্তা বাঙালিকে মোহিত করে। কবি সাহিত্যিক, শিল্পী ও সৃজনশীল মানুষের কাছে এই বসন্ত ঋতুরাজ, যৌবনের প্রতীক। প্রেমিক হৃদয়ে প্রেমের বার্তাবাহক, মধুমিলন সারথি। গবেষকের কাছে এই ঋতু নবজীবনের দূত, প্রধান ঋতু। আর সচেতন মানুষের কাছে নবজাগরণের পথিকৃত, নবধারার অগ্রদূত।
বসন্তের আগমনে প্রকৃতি তার জীর্ণতা মুছতে শুরু করে। বসন্ত এসে তাকে দান করে যৌবনের উন্মাদনা। ফলে মৃতপ্রায় নগ্ন গাছের ডালপালা ভরে ওঠে নতুন সবুজ পাতার সমাহারে। শুকনো মাটির বুক ফেটে বেরিয়ে আসে মসৃণ সুন্দর সবুজ কচি ঘাস।
প্রকৃতির বুকে বসন্ত আসে ফুল-ফলের সৌন্দর্য ও সৌরভ নিয়ে। ঋতুরাজ বসন্তের এই অপূর্ব প্রাকৃতিক দান-সম্ভার বাংলাদেশের চিরশ্যামল প্রকৃতিকে নবরূপ ও অপরূপ ঐশ্বর্যে ঝলমল করে তোলে। বসন্তের আগমনে পল্লবিত হয় তরুলতা।
শীতে ম্রিয়মাণ প্রকৃতি বসন্তে জাদুর পরশে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। নানা ফসলে ভরে যায় মাঠ। এ সময় আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি গাছ মুকুলিত হয়। সেই মুকুলের গন্ধে হৃদয় ভরে যায়। এই মৌসুমী ফুলের মুকুলের গন্ধে মৌমাছিরা মধুর লোভে ব্যাকুল হয়ে ছোটে গাছে গাছে। ফুলের বনে ভ্রমরের গুনগুন গুঞ্জনে চারদিক মুখরিত হয়। প্রজাপতি রঙিন পাখা মেলে উড়ে চলে মনের সুখে।
ভ্রমরের গুঞ্জন, কোকিলের কুহু কলতান, আর পাপিয়ার পিউ পিউ ডাকে, বসন্তবেলায় চারদিক থাকে মুখরিত। বসন্ত বাউরি ‘বউ কথা কও’ বলে থেকে থেকে হাঁক ছেড়ে চারদিকে বসন্তের জয়ধ্বনি তোলে।
প্রকৃতির এই সুর ও ছন্দময় সৌন্দর্য কবির হৃদয় ও প্রেমিকের মন উতালা করে দেয়। মানব মনে জাগে কত কথা, কত সুর, আর কত গান। তাই বসন্তের রূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ কবিগুরুর কণ্ঠে শুনি, ‘আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে,/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়,/ আহা আজি এ বসন্তে।’
ফাল্গুনের হাত ধরেই ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। বসন্তকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়। বসন্তের এই শুভাগমনে প্রকৃতির সঙ্গে মানব হৃদয়েও দোলা লাগে। সব কুসংস্কার ও বিভেদ ভুলে নতুন প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে আসে বসন্ত। ফাগুনের মাতাল হাওয়া দোলা দেয়, বাংলার নিসর্গ প্রকৃতিতে। নতুন রূপে প্রকৃতিকে সাজায় ঋতুরাজ বসন্ত।
ফুলের বসন্ত, মধুর বসন্ত, যৌবনের বসন্ত এবং আনন্দ, উল্লাস ও আবেগ-উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত বসন্ত, বাংলার প্রকৃতি ও বাঙালির মনে-প্রাণে নতুন জীবনের বার্তা বয়ে আনে। প্রেম-ভালোবাসার আবাহনে এই বসন্ত মধুর মিলনের ডাক দেয় । ফাগুনের আগুন ঝরানো যৌবনবতী প্রকৃতি, প্রাণে প্রাণে মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায়। তাই মুগ্ধ বসন্তে কবি বলছেন, ‘মহুয়ার মালা গলে কে তুমি এলে,/ নয়ন ভুলানো রূপে তুমি এলে,/ শীতের শেষে মুহুর্তে নবজাগরণের ডাক দিয়ে তুমি এলে।’
দ্যুতিময় বুলবুল: লেখক, সাংবাদিক, গবেষক।
Print Friendly

Related Posts