রেজাউল করিম : দেশের সবচেয়ে বড় জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। ৩৮১ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা পার্কটি ২০১৩ সালে উদ্বোধন করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠার পরে আর আমদানি হয়নি নতুন কোন প্রাণী কিংবা করা হয়নি দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন। ইতোমধ্যে মারা গেছে অনেক প্রাণী। নতুন প্রাণী আনার নেই কোনো উদ্যোগ। নেই চোখে পড়ার মতো কোনো সৌন্দর্য্য।
শিক্ষক মাফুজা আক্তার বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পার্কে এসেছিলাম কিন্তু পার্কটি নিয়ে যা শুনেছিলাম তার কিছুই দেখতে পাইনি। পশুপাখিগুলো রোগা হয়ে আছে। খুব বেশি দেখার কিছু নেই।
তার মতো শত শত দর্শনার্থী ঘুরে যাচ্ছেন হতাশ হয়ে। একবার যারা ঘুরে যাচ্ছেন দ্বিতীয়বার আর আসার কথা চিন্তাও করছেন না। ফলে আকর্ষণ হারাচ্ছে সাফারি পার্কটি। বেড়াতে এসে বিভিন্ন মাধ্যমে দিচ্ছে নেগেটিভ রিভিউ, কেউ কেউ প্রকাশ্যেই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্ক প্রতিষ্ঠার সময় কয়েক ধাপে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন প্রাণী আমদানি করা হয়। এরপর বিভিন্নভাবে অনেক প্রাণী কমলেও শূন্যতা পূরণের দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। এছাড়াও অর্গানোগ্রামে আড়াইশ জনের লোকবল চাহিদা থাকলেও রয়েছেন মাস্টাররোলে ৭০ জন।
শুরুতেই পার্কটি বঙ্গবন্ধু চত্বর, কোর সাফারি, সাফারি কিংডমসহ পার্কটি পাঁচটি অংশে বিভক্ত রয়েছে। বাঘ, ভাল্লুক, সিং, হরিন, জিরাফ, জেব্রা দেখার জন্য কোর সাফারি ঘুরে দেখানোর জন্য রয়েছে বাস। সাফারি কিংডমে প্যারট এভিয়ারি, ক্রাউন ফিজেন্ট এভিয়ারি ম্যাকাউ ল্যান্ড, ছোট পাখিশালা, ফেন্সি ডাক গার্ডেন, কুমির পার্ক, প্রজাপ্রতি বাগান, ইমু/অস্ট্রিচ গার্ডেন কচ্ছপ ও কাছিম প্রজনন কেন্দ্র, হাতি শালা, মেরিন অ্যাকুরিয়াম, অর্কিড হাউ, ঝুলন্ত ব্রিজ, ধনেশ অ্যাভিয়ারিসহ বেশকিছু ইভেন্ট। এছাড়াও শিশুকিশোরদের বিনোদনের জন্য শিশু পার্ক।
সাফারি পার্কে অফিস বলছে, বর্তমানে রয়েছে ৮টি বাঘ, ৪টি সিংহ, নতুন বাচ্চাসহ ২৭টি জেব্রা, জিরাফ ২টি, ওয়েল ফিস ১১টি, নিলগাই ৯টি, গয়াল ১৪টি, সাম্পা হরিণ ৬টি, হাতি ৮টি, জলহস্তী ৪টি, চিত্রাহরিণ শতাধিক, ময়ুর শতাধিক, কুমির ১১টি, ঘরিয়াল ৫টি, বেশ কয়েকটি উল্লুক ও কয়েক হাজার দেশি বিদেশি পাখি।
৫০ টাকা টাকা টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশ করে গুটি কয়েক পাখি, সাপ, কুমিড়, বানর ছাড়া তেমন আর কিছুই দেখা যায়না। পার্কের বেশিরভাগ দর্শনীয় জিনিসগুলো টিকেটের বিনিময়ে দেখতে হবে। পার্কের ভেতরের বিশালাকার লেকে প্যাডেল বোটগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। সাফারি পার্কের উত্তর-পশ্চিম অংশের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত শিশু পার্কের অবস্থা জরাজীর্ণ। যা প্রতিষ্ঠার পর আর সংস্কার করা হয়নি।
সূত্র বলছে, সাফারি পার্কে রয়েছে সহকারী বন রক্ষক ১ জন, ভেটেনারি সার্জন ১ জন, ওয়াইল্ডলাইফ পরিদর্শক ১ জন, ওয়াইল্ডলাইফ সুপারভাইজার ১ জন, ওয়াইল্ডলাইফ স্কাউট ৩ জন, ফরেস্টার ২ জন, ল্যাব টেকনিশিয়ান ২ জন, কম্পাউন্ডার ২ জন, টেক্সিডামিষ্ট ১ জন, অ্যানিম্যাল কিপার ৬ জন, বন্যপ্রাণী রক্ষক ১ জন, জুনিয়র ওয়াইল্ডলাইফ ১০ জন, হাতির মাহুত ৬জন, বাগান মালি ৪ জন, নিরাপত্তা প্রহরী ১ জন, ইলেক্ট্রিশিয়ান ২ জন, প্লাম্বার ১ জন, ড্রাইভার ১ জন, অফিস সহায়ক ১ জন, গেইটম্যান ১১ জন, গ্রাস কাটার ২ জন ও পরিচ্ছন্ন কর্মী ৪ জন৷ এরমধ্যে ৩২ জন সরকারি বাকি ৩৮ জন রয়েছে মাস্টার রোলে৷ এরমধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকজন কিশোর।
গত বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০ টার দিকে পার্কের প্রধান ফটকের টিকেট কাউন্টার থেকে ৫০ টাকা দিয়ে টিকেট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি। প্রথমেই রয়েছে পুরো পার্কের একটি মানচিত্র। মানচিত্রটি সুন্দর ও নান্দনিক থাকলেও পার্কের সঙ্গে যার কোনো মিল পাওয়া যায়নি। তবে কোথায় কি আছে সেই নির্দেশনাগুলি ঠিক ঠাক ছিল। পার্কের বেশিরভাগ দর্শনীয় জিনিস টিকেটের বিনিময়ে দেখতে হচ্ছে। ৪ টি পাখিশালা ও ১ টি অ্যাকুরিয়াম ঘুরে দেখতে জনপ্রতি গুনতে হচ্ছে ১২০ টাকা। টিকেট কাউন্টারে বসে ডাকছেন এক কিশোর। কিছুদূর এগিয়ে পার্কের ভেতরের বিশালাকার লেকে প্যাডেল বোটগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। সাফারি পার্কের উত্তর-পশ্চিম অংশের বিশাল এলাকাজুড়ে শিশু পার্কের অবস্থা খুবই খারাপ। এটি প্রতিষ্ঠার পর আর সংস্কার করা হয়নি। বাহির থেকে সুন্দর মনে হলেও বেশিরভাগ রাইড ভাঙা। তবুও মাত্র ৫ টি রাইডের জন্য গুনতে হচ্ছে ২৫০ টাকা। ইন্দোনেশিয়ার কইকাপ মাছের খেলা দেখতে লাগছে ৬০ টাকা৷ ধনেশ এরিয়ায় যেতে হলে লাগে ১০০ টাকা। একটু সামনে এগুলো দেখা যায় এক কিশোর বসে আছে টিকিট নিয়ে। সামনেই ঝুলন্ত ব্রিজ, এটি পার হতে তার থেকে নিতে হচ্ছে ১০ টাকার টিকেট। এছাড়াও কোর সাফারিতে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে ১০০ টাকা। ৫০ টাকার টিকিট কেটে কয়েকটি বানর, চিল, শুকুন, দুটি আজগর, কয়েকটি কুমির, ঘরিয়াল, উল্লুক আর দুটি জলহস্তী দেখে অসন্তুষ্ট দর্শনার্থীরা।
রাজশাহী নিউ ডিগ্রি কলেজ থেকে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান জানান, কলেজ থেকে ঘুরতে এসেছি, জায়গাটা অনেক বড় কিন্তু দেখার মতো বেশি কিছু নেই। যেমন শুনেছি বাস্তবে তার মিল নেই। হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু বলার নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা এমরান হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগেও সাফারি পার্ক নিয়ে আমরা গর্ব করতাম। কিন্তু এখন অনেক কম লোকজন ঘুরতে আসে। এলাকার লোকজন তো পার্কে যায়না, দূরের লোকজন আসে। এসেও ভালো কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। এরপর অনিয়ম তো আছেই।
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, পার্কের কিছু সমস্যা সমাধানও করা হয়েছে। তারপরও অনেক সমস্যা রয়েছে। সাধ্যমতো চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে পরিস্কার রাখা যায়। প্রতিষ্ঠার পর পার্কে নতুন কোনো প্রাণী আনা হয়নি। জন্ম নেওয়া এবং বিভিন্ন জায়গা হতে পাওয়া প্রাণী দিয়েই চলছে৷ আমাদের লোকবল কম। আড়াইশ লোকবল প্রয়োজন সেখানে রয়েছে মাত্র ৭০ জন। চিকিৎসকেরও সংকট রয়েছে।