ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র
শাহ মতিন টিপু
আমাদের দেশে ছাপা প্রচারমাধ্যমের খুব সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। এই উপমহাদেশে সংবাদপত্রের আগমণ ১৭শ শতকে। জেমস অগাস্টাম হিকি সম্পাদিত বেঙ্গল গেজেট (সাপ্তাহিক) কে ভারতবর্ষে প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র বলা হয়।
সে ইতিহাসে পা বাড়ালে দেখতে পাই- ১৮১৮ সালে প্রকাশিত দিকদর্শন (মাসিক) সম্পাদক জন ক্লার্ক মার্শম্যান বাংলা ভাষায় প্রথম সাময়িকপত্র। একই বছরে প্রকাশিত সমাচার দর্পণ (সাপ্তাহিক) এর সম্পাদকও ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। পত্রিকাটি শ্রীরামপুর মিশনারি কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
সমাচার দর্পণকে বলা হয় বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র। ১৮২১ সালে প্রকাশিত- সম্বাদ কৌমুদী ও ব্রাহ্মণসেবদি নামের দুটি পত্রিকারই সম্পাদক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়।
ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’ এর সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন জেমস অগাস্টাস হিকি। যা ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে। দুই পৃষ্ঠার এ পত্রিকাটির আকার ছিল ১২ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ৮ ইঞ্চি প্রস্থ। এটি দুই বছর পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছিল। ২৩ মার্চ ১৭৮২ সালে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতবর্ষের এই প্রথম সংবাদপত্রটির জন্ম কলকাতায়। এ পত্রিকা সাড়া ফেলে দেয় কলকাতাজুড়ে। কিন্তু অচিরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চক্ষুশূল হয়ে ওঠে এ পত্রিকা।
‘দল-মতনির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত, কিন্তু কারো দ্বারা প্রভাবিত নয়’ -এই স্লোগান নিয়ে পত্রিকাটির যাত্রা শুরু। তখন কলকাতার বয়স ৯০ বছর। জেমস অগাস্টাস হিকি ছিলেন আইরিশ বংশোদ্ভূত। স্লোগানটি তিনি শুধু কথার কথা হিসেবে লেখেননি। মন থেকে এটাই তিনি বিশ্বাস করতেন। আর এই নীতির জন্যই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রোষানলে পড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ভারত ছাড়তে বাধ্য হন হিকি।
সংবাদপত্রে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন, নিরপেক্ষ ও সাহসী এক পুরুষ। ১৭৭৪ সালে তিনি ভাগ্যান্বেষণে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম থেকে ভারতের হিজলিতে আসেন। কর্মজীবনের প্রথমে তিনি জাহাজের ব্যবসা শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত এ ব্যবসায় বড় ধরনের মার খেয়ে খবরের কাগজ বের করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তের ফসল হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’।
কী ছিল বেঙ্গল গেজেট-এর বার্তা? খবরের বিষয়বস্তু হিসেবে হিকি বেছে নেন সামাজিক সমস্যাগুলোকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রাস্তাঘাট, বিভিন্ন স্থাপনা, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং ময়লা-নর্দমার সঠিক ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া তার পত্রিকায় আলাদা পাতা ছিল রাজনীতি, বিশ্ব সংবাদ এবং ভারতের খবর নিয়ে। সাধারণ পাঠককে চিঠি থেকে কবিতা, সব ধরনের লেখা পাঠাতেই উৎসাহ দিতেন হিকি।
মানুষ বিষয়টা লুফে নিল। এত দিন প্রত্যেককে নিজের মতো করে সামাজিক সমস্যাগুলোর কথা বলতে হতো। এখন তাদের একটা মুখপাত্র হয়েছে। তারা নিজে থেকে তো বলেই, পাশাপাশি চিঠি লিখলেও প্রকাশ করে। আরেকটা সুবিধা হয়েছে, দূরের কাউকে চিঠি পাঠালে ওতে স্থানীয় রাজনৈতিক কোনো ঘটনা বিস্তারিত লিখে জানাতে হয় না। পত্রিকার কথা বললেই হলো। তার পত্রিকার অন্যতম বড় হাতিয়ার ছিল বিদ্রুপ বা স্যাটায়ার ও লেখার রম্যভঙ্গি। শহরের রঙিন চরিত্রদের ডাকনামও দিতে শুরু করে তার পত্রিকা। যেমন কলকাতা শহরের জনকল্যাণ বিভাগের প্রধান এডওয়ার্ড টিরেটার ডাকনাম দেন ‘নোসি জার্গন’। নোসি মানে, যে অন্যের ব্যাপারে অযথা নাক গলায়। আর জার্গন মানে, কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের পরিভাষা। প্রথমাংশটা আক্ষরিক অর্থে বললেও দ্বিতীয়াংশ দেওয়া হয়েছে বিদ্রুপ করে। কারণ, ইতালি থেকে আসা টেরেটা সাহেব ইংরেজি, ফ্রে , পর্তুগিজ ও হিন্দি ভাষা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি উদ্ভট এক ভাষায় কথা বলতেন। শুনে মনে হতো, বিভিন্ন কঠিন পরিভাষা বলে যাচ্ছেন টানা। এ রকম ডাকনাম ও বিদ্রুপ বেঙ্গল গেজেটকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে।
প্রমাণ ছাড়া কোনো বিতর্কিত জিনিস ছাপাতেন না তিনি পত্রিকায়। বরং সেসব প্রকাশে অন্য কৌশল বেছে নেন। বিভিন্ন মতের, বিভিন্ন ধরনের মানুষের লেখা ও চিঠি প্রকাশ করতেন। এমনকি তার নিজের মতের বিরুদ্ধে চিঠিও প্রকাশ করেছেন তিনি। মেয়েদের যৌন অধিকার থেকে শুরু করে ধর্ম বা বর্ণের কারণে সৃষ্ট দলাদলির সমস্যা নিয়েও লেখা প্রকাশিত হয়েছে হিকি’স বেঙ্গল গেজেটে। কিন্তু অযথা বিতর্ক উসকে দেয়, এ রকম কিছু ছাপানো হতো না। যেমন ধর্মীয় দলাদলি উসকে দেবে, এমন চিঠি ছাপাতে রাজি হননি হিকি ।
এভাবেই প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে ‘হিকি’স বেঙ্গল গেজেট’। বিক্রি হয়েছে ১ রুপিতে। হিকি’স বেঙ্গল গেজেট- ৪০০-৫০০ কপির মতো বিক্রি হতো সে সময়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বেঙ্গল গেজেট-এর বিরুদ্ধে একসময় স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হলো। তাদের সমালোচনা করে একের পর এক কলাম ও সংবাদ তাদের ক্রুদ্ধ করে তুলল। আরেকটি পত্রিকা জন্ম দেয়াকেই তারা সমাধানের উপায় হিসেবে বেছে নিল। প্রকাশ হলো আরেকটি পত্রিকা। ভারতবর্ষের দ্বিতীয় ছাপা পত্রিকা হিসেবে যাত্রা শুরু করল দ্য ইন্ডিয়া গেজেট; অর ক্যালকাটা পাবলিক অ্যাডভার্টাইজার। ১৭৮০ সালের ১৮ নভেম্বর প্রকাশিত হয় দ্য ইন্ডিয়া গেজেট-এর প্রথম সংখ্যা। সেদিনই হিকি তাঁর পত্রিকার নাম বদলে রাখেন হিকি’স বেঙ্গল গেজেট; অর দ্য অরিজিনাল ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভাইজার।
এদিকে ভারতের গভর্নর জেনারেল বা প্রশাসক ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রী মেরিয়েন হেস্টিংসের সঙ্গে হিকির বিরোধ আরও জোরালো হয়ে ওঠে। কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তারা হিকির নিবন্ধিত পাঠকদের কাছে পত্রিকা ডাকে পাঠানো নিষিদ্ধ করেন। এবারে হিকি ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লেখেন, হেস্টিংস তার বাক স্বাধীনতা খর্ব করছেন। পাশাপাশি, দুর্নীতি-শোষণের অভিযোগ থেকে শুরু করে হেস্টিংসকে ব্যক্তিগত পর্যায়েও আক্রমণ করেন তিনি। বিলেতি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি পদাধিকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনেন হিকি। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে কর্মরত প্রধান বিচারপতি এলিজাহ ইম্পের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ করেন তিনি। হেস্টিংস ও কোম্পানির অন্যান্য বড় কর্মকর্তা এ সময় মামলা করে দেন হিকির বিরুদ্ধে। চার দফা শুনানির পর ১৭৮১ সালের জুনে হিকিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। জেল হয় তাঁর। হিকি কিন্তু দমলেন না। জেলে বসেই প্রকাশ করতে লাগলেন পত্রিকা। লেখার ভাষাতেও এল না কোনো পরিবর্তন। একের পর এক অভিযোগ প্রকাশিত হতে লাগল হেস্টিংস ও কোম্পানির অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
আবার হিকির বিরুদ্ধে মামলা করলেন হেস্টিংস। এবারে হিকির পত্রিকা প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল আদালত। ১৭৮২ সালের ৩০ মার্চ বন্ধ হয়ে গেল হিকি’স বেঙ্গল গেজেট। পত্রিকা প্রকাশের সব যন্ত্রপাতি, টাইপিং যন্ত্র ইত্যাদি জব্দ করল সরকার। পরের সপ্তাহে নিলাম ডাকা হলো সেগুলো বিক্রির জন্য। নিলামে এসব যন্ত্র কিনে নেয় ‘দ্য ইন্ডিয়া গেজেট’। এর মাধ্যমে বিলুপ্তি ঘটে ভারতবর্ষের প্রথম পত্রিকার।
১৭৮৪ সালে হেস্টিংস যখন বিলেতে ফিরে যান, তখন জেল থেকে মুক্তি পান হিকি। তাঁর এর পরের জীবন নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। শুধু জানা যায়, জেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন হিকি। সম্পদ হারিয়ে তার পরের জীবন কাটে প্রচণ্ড দারিদ্র্যে। একসময় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে নিজ মাতৃভূমি ব্রিটেনে যাওয়ার অর্থ সংগ্রহের জন্য চীনের উদ্দেশে জাহাজে যাত্রা করেন হিকি। কিন্তু তার আর চীনে যাওয়া হয়নি। এর আগেই হিকি হয়ে যান সংবাদ। ১৮০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘ক্যালকাটা গেজেটে’ প্রকাশিত হয় ছোট্ট একটি খবর- ‘চীনে যাওয়ার পথে সমুদ্রে জাহাজের মধ্যেই শেষনিঃশ্বাস ফেলেছেন জেমস অগাস্টাস হিকি।’