একজন সাধনা মহল অসংখ্য প্রতিবাদ!

সাকিলা মতিন মৃদুলা

সব কিছুই একেবারে ঝকঝকে চকচকে! পুরোটাই নারীর অধিকার! স্বামী বা স্ত্রী যিনিই ডিভোর্স দেন না কেন এই অধিকার থেকে নারী বঞ্চিত হবেন না কোন ভাবেই! বলছি দেনমোহরের কথা। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এটা বিয়ের একটি অপরিহার্য নিয়ম যা স্ত্রীর প্রাপ্য! সম্পত্তির সমান অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত রাখার পক্ষগোষ্ঠীর জন্য নারীর দেনমোহরের অধিকার একটি শক্তিশালী যুক্তিও বটে! অন্যদিকে এক অর্থে দেনমোহর নারীর নিরাপত্তাও বটে!

সমানাধিকারের যুগে দেনমোহর কেন এবং কিভাবে নারীর নিরাপত্তা হয়? প্রশ্নটা সহজ কিন্তু উত্তর কঠিন এবং গভীর! ধুমধাম করে বিয়ে করে তিনদিন পরেই কারন ছাড়া মনে হলো বউ ভালো না! শ্বশুড়বাড়ীর মন মতো হলোনা তাই এই বউ চললো না! কন্যা দায় গ্রস্ত পিতা যথেষ্ট উপঢৌকন (যৌতুক) দিতে পারলেন না বিধায় মেয়ের আর সংসার করা হলোনা! এই সমস্ত অন্যায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় একটি শক্ত খুঁটি “দেনমোহর”! দেনমোহর দিতে হবে বলেই অনেক ক্ষেত্রেই আটকে যাওয়ার কথা এইসমস্ত অন্যায়-অযৌক্তিক ডিভোর্সগুলো! অথচ বাস্তবে দেনমোহরের জন্য আটকে থাকে না অযৌক্তিক এবং অন্যায় ডিভোর্স! তালাকের নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পর কার্যকর হয়ে যায় ডিভোর্স! তালাকের নোটিশ ফরমের কোথাও দেনমোহর পরিশোধ সংক্রান্ত তথ্যের জন্য কোন ঘর বা স্থান নেই! সত্যিই সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ! সুক্ষভাবে দেনমোহর পরিশোধের দায়ভার থেকে স্বামীকে নিস্তার দিচ্ছে শুভংকরের ফাঁকি সিস্টেম! তাহলে পথ কি? স্বেচ্ছায় না দিলে মামলার মাধ্যমে দেনমোহর আদায় করা! হাস্যকর! বিবাহিত জীবনে কজন মেয়ে দেনমোহরের টাকা নেয় তার স্বামীর কাছ থেকে? আর অন্যায় অযৌক্তিক ডিভোর্সের দায়ভার নিয়ে কজন নারী যায় বা যেতে পারে আদালত পর্যন্ত? এক্ষেত্রে সুশীল সিস্টেমের বিবেক কি বলে?

এবার আসি যৌতুক প্রসঙ্গে! আমি যেমন জানি আপনিও জানেন- নিম্নবিত্ত অসহায় দরিদ্র পরিবারে এমনকি গ্রামের গৃহস্থ ঘরেও যৌতুক ছাড়া বিয়ে হয়না! কি জানেন না? যদি না জেনে থাকেন বেশি দুরে যাবার দরকার নেই , আপনার গৃহকর্মীর সাথে কথা বলুন! তার জীবনের গল্পটা জানুন! শুনুন যৌতুক ছাড়া তাদের বিয়ে হয় কি হয় না! সবকিছু জানা এবং বোঝার পরও কি বলছে বা করছে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮? বিরাট পরিবর্তন এসেছে সেখানে! এখন শুধু বরপক্ষের বিরুদ্ধে নয় কনে পক্ষের বিরুদ্ধেও যৌতুক বিরোধী মামলা করা যাবে! প্রচুর মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধেও রুখে দাড়িয়েছে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮! সেখানেও আছে সংস্কার! কেননা পুরুষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে নাকি ব্যবহৃত হচ্ছে এই আইন!

অথচ সম্পত্তিতে অধিকারহীনতায় নারীর অসহায়ত্ব আজও পারিবারিক আইনে সংস্কার আনতে পারলোনা! সেখানে কোন যুক্তিই খাটেনা,খাটছেনা! নিদারুন নয় কি? এত এত কথা বলার কারণ সাধনা মহল এবং গোবিন্দ বর! অক্টোবর ২০২২ এ “স্পেশাল ম্যারেজ আইনে” তাঁদের বিয়ে হয়। দুজন শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধির ব্যক্তিগত পারিবারিক কোন্দল এখন জনসমুক্ষে! প্রথম বিষয়টি জনসমুখে আসে একটি জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের সংবাদ ভাইরালের মাধ্যমে! অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়! খুব স্বাভাবিকভাবেই সংবাদটি ছিলো সাধনা মহলকে নিয়ে! সংবাদে হেডিং ছিলো অর্থলোভী, বিয়ে ব্যবসায়ী, দুশ্চরিত্র সাধনা মহল! এই দেশে এর চাইতে রুচিকর কিছু আশা করা যায় কি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে পড়াশোনা করা অবস্থায় সাধনা ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ে কালচারাল এনথ্রপলজি বিষয়ে পড়াশোনা করতে যান। সেখানে অনার্স এবং মাষ্টার্স শেষ করে দীর্ঘ ২২ বছর বাংলাদেশে পিপিডি, সেভ দ্যা চিল্ড্রেন, সুইস ডেভলপমেন্ট করপোরেশন, এওত সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এবং জাতীয় বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরী করেন। ছাত্রজীবনে বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্র এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তিনি কাজ করেন। এমন একজন ব্যাক্তিকে নিয়ে কত সস্তা হেডিং করে দিলেন সাংঘাতিক সাংবাদিকেরা! মান সম্মানের অজুহাতে পিছিয়ে যাবেন সাধনা মহল? কিন্তু পিছিয়ে আর কতদিন?

গোবিন্দ বরও একজন সাংবাদিক ছিলেন, বর্তমানে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে কর্মরত। গোবিন্দ বর জাহাঙ্গীর নগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করেছেন! ধরে নিলাম নিতান্তই অসহায়, হতদরিদ্র, পাতলা গড়নের গোবিন্দ বরকে কুস্তিগীর(!) সাধনা মহল খুব সহজেই আছাড় মেরে রক্তাক্ত করেছেন, নির্যাতন করেছেন! গোবেচারা গোবিন্দ সেটার জন্য সস্তা চরিত্র ধোলাইয়ের পথ বেছে নিলেন কেন? মহামান্য সিস্টেম আপনার বিবেক কি বলে?
চুরির মামলায় গ্রেপ্তার হলেন সাধনা মহল! অমানবিক পরিবেশে কাটালেন একটি রাত! বিবাহিত অবস্থায় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আবার চুরিরও মামলা হয় জানতাম না! কত যৌক্তিক মামলা নেয়না থানা! আবার কত অযৌক্তিক মামলা নিয়ে নেয় কত সহজে! ফিনল্যান্ড থেকে ফেরার পর ঘরের তালা বদলে ফেলায় ঘরে ঢুকতে পারেন নি সাধনা মহল! বাড়ী থেকে আগেই প্রযোজনমতো আসবাবপত্র নিয়ে যায় গোবিন্দ বর! থানায় যান সাধনা মহল! অভিযোগ করেন! থানা থেকে বলা হয় বিবাহিত অবস্থায় চুরির মামলা হয়না! অথচ সাধনা জানতেন না তার নামে আগেই চুরির মামলা করা হয়েছে! অথচ গোবিন্দ বর নিজে সাধনা মহলের অনুপস্থিতিতে মালামাল সরিয়েছে! সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সহ যথেষ্ট প্রমান দেবার পরও বিষয়টি আমলে নিচ্ছিল না সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ! সে যাই হউক শেষ পর্যন্ত চুরির মামলা টেকেনি! প্রমাণিত হয় সাধনা নিরপরাধ! খারিজ হয় চুরির মামলা! তারপরও থেমে থাকেনি সিস্টেমের ফাঁকফোঁকর! হয়রানি, মামলা, গ্রেপ্তার, চরিত্র ধোলাই কোন কিছুই বাদ নেই, থেমেও নেই! চলছে তো চলছেই!

দেনমোহরের অধিকারে আছে শুভংকরের ফাঁকি! যৌতুক বিরোধী আইনে এরই মধ্যে হয়ে গেছে সংস্কার; সমানাধিকার! অথচ সম্পত্তিতে আজও নারী পায়ের তলার মাটি শূন্য! বাবার সম্পত্তিতে অর্ধেক ছেলেরা নেয়! আর যখন ছেলে থাকেনা তখন ভাইয়েরা নেয়! কি হাস্যকর! অপমানজনক কি?
আমি বলবোনা সবটাই পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র! ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, অবিবেচক, লোভী, অশিক্ষিত, অমানুষদের তৈরী ফাঁদ পাতা জালে এখনও আটকে আছে সিস্টেমের ফাঁকফোঁকর, আইন এবং মানুষের জীবন! সাধনা মহল এই ফাঁদ পাতা জালে আটকে গেছেন। তিনি আপোষ করেন নি! প্রতিবাদ করেছেন! এভাবেই একের পর এক প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে হয়তো কোনো একদিন মানুষর পাশে পরিপূর্ন ভাবে দাঁড়াবে অধিকার! থাকবেনা শুভংকরের ফঁকি!

লেখক : মিডিয়া কর্মী।

Print Friendly

Related Posts