শিরিন সুলতানা কেয়া: পানিপিয়া ইয়ুথ ক্যাম্পের প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে ফজলুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ক্যাম্পের প্রশাসক ক্যাপ্টেন আর কে শর্মা আর ইনচার্জ অ্যাডভোকেট মো. মুহসীন স্বাক্ষরিত সনদপত্র রয়েছে তার। স্বাধীনতার পর মিলিশিয়া ক্যাম্পে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীর সই করা সনদপত্রও পেয়েছেন। মিলিশিয়া ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাতেও নাম রয়েছে তার। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিই পাননি তিনি।
রাজশাহী মহানগরীর কাদিরগঞ্জ আমবাগান মহল্লায় রেললাইনের পাশে ছোট্ট জরাজীর্ণ এক বাড়িতে বাস করেন ফজলুল হক। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নারায়ণপুরে বাড়ি ফিরে যান। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান ভারতে। সেখানে ফজলুল হককেই প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অনেক যুবককে তিনি প্রশিক্ষণ দেন। তারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু স্বীকৃতি পাননি ফজলুল হক। আদৌ স্বীকৃতি পাবেন কি না তা জানেন না ৭৪ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা।
সম্প্রতি ফজলুল হকের বাড়ির বৈঠকখানায় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, তিনি থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে হল বন্ধ হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে যান। এলাকায় রাজাকারদের নির্যাতন দেখে তারা ৮ জন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান লালগোলা ট্রানজিট ক্যাম্পে। ২ সপ্তাহ পর তাদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় পানিপিয়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে দেখেন প্রায় ৮০০ যুবক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রশিক্ষণের সময় ফজলুল হকের দক্ষতা দেখে তার সঙ্গে কথা বলেন প্রশিক্ষকেরা।
ফজলুল হক বাংলার ছাত্র থাকলেও সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে ছিল মিলিটারি সায়েন্স অ্যান্ড হিস্ট্রি। তা শুনে পানিপিয়া ক্যাম্পের এক প্লাটুনের কমান্ডার হিসেবে ফজলুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতি ব্যাচে তিনি ৪০ থেকে ৫০ জন যুবককে প্রশিক্ষণ দিতেন। লংমার্চ, নাইটমার্চ, অ্যাম্বুস করা শেখাতেন। গ্রেনেড ছোঁড়া, এসএমজি, এলএমজি আর রাইফেল চালানো শেখাতেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি ওই ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন।
স্বাধীনতার পর ক্যাম্প গুটানোর পর ডিসেম্বরের শেষে দেশে ফিরে আসেন। কিছুদিন পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের মিলিশিয়া ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ দিনের জন্য সমবেত হন। ফজলুল হক সেখানেও যোগ দেন। ক্যাম্প থেকে ফিরে আবার পড়াশোনায় মন দেন। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে বের হন। তারপর নতুন একটি কলেজে কিছুদিন প্রভাষক হিসেবে চাকরি করেন। বেতনের সমস্যার কারণে শিক্ষকতা ছেড়ে ১৯৭৫ সালে অগ্রণী ব্যাংকে যোগ দেন। ২০০৩ সালে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নেন।
ফজলুল হক জানান, ১৯৮৯ সালের দিকে প্রথম যখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করা শুরু হয়, তখন তিনি জানতেই পারেননি। দ্বিতীয়দফায় পর্যায়ে তিনি আবেদন করেন। কিন্তু তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। পরে চট্টগ্রামে কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকার কারণে আর এগোতে পারেননি। অবসরগ্রহণের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে কয়েকদফা আবেদন করেছেন। সবশেষ ২০১৭ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। মন্ত্রী আবেদনপত্রের ওপর লিখে দেন, ‘উপজেলায় যাচাই-বাছাই হবে।’ এরপর ২০২২ সালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে আরেকদফা মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠান। কিন্তু কোন অগ্রগতি হয়নি। ফজলুল হক তার কাগজপত্র নিয়ে এর-ওর কাছে ঘুরে বেড়ান।
ফজলুল হক তার কাছে থাকা কাগজপত্র বের করে দেখান। এতে দেখা যায়, ২০২২ সালে সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন একটি আধা-সরকারি চিঠি দিয়েছেন। এতে তিনি বলেছেন, ফজলুল হক নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক। তিনি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। দীর্ঘদিনেও স্বীকৃতি না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
নাটোরের প্রয়াত সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুস পানিপিয়া ক্যাম্পের পলিটিক্যাল মোটিভেটর ছিলেন। তিনি ফজলুল হককে দেওয়া প্রত্যয়নপত্রে লিখেছেন, ‘ফজলুল হক এখনও তালিকাভুক্ত হতে পারেন নাই। এই বিষয়টি জানার পর আমি হতবাক হয়েছি।’
চারঘাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মিজানুর রহমান আলমাস এক প্রত্যয়নপত্রে লিখেছেন, ‘ফজলুল হক পানিপিয়া ইউথ ক্যাম্পে আমার বি কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি ওই ক্যাম্পের বি কোম্পানির অ্যাডমিনের দায়িত্বে ছিলাম।’
ফজলুল হক পানিপিয়ার প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে ক্যাম্পের প্রশাসক ক্যাপ্টেন আর কে শর্মা আর ইনচার্জ অ্যাডভোকেট মো. মুহসীনের কাছ থেকে পাওয়া সনদপত্র বের করে দেখান। স্বাধীনতার পর মিলিশিয়া ক্যাম্পে যোগ দিয়ে পাওয়া বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীর সই করা সনদপত্রও দেখান। মিলিশিয়ায় অংশ নেওয়া প্রায় ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকাও তিনি সংগ্রহ করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। সেই তালিকাও বের করে দেখান তিনি। তালিকায় তার নাম রয়েছে।
ফজলুল হক বলেন, ‘সব জায়গায় আমার নাম আছে। আমার কাছে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাদেরও অনেকেই এখন বেঁচে আছেন। তারা খোঁজ নেন। সাক্ষী দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু আমি এখনও তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হতে পারিনি। তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে অনেক কিছুই ঘটে। আমি ওসব পথে না। আমি সৎপথে চেষ্টা করেছি, পারিনি। দেশের জন্য কাজ করে এটাই কি আমার প্রতিদান?’
তিনি বলেন, ‘অবসরজীবনে আমি এখন চরম আর্থিক সংকটে আছি। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটা পেলে আমার পরিবার উপকৃত হবে। মৃত্যুর আগে আমি এই স্বীকৃতি পাব কি না তা জানি না। মৃত্যুর আগে এটাই আমার জীবনের শেষ চাওয়া।’
ফজলুল হকের স্ত্রী মেহেরুন নেসা বললেন, ‘মাঝে মাঝেই তিনি কাগজগুলো বের করেন। বিছানার ওপর সবগুলো বিছিয়ে রেখে দেখেন আর চোখের পানি মোছেন। আবার সব কাগজপত্র বগলে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। বিমর্ষ মুখে ফিরে আসেন। এই দৃশ্য বহুদিন ধরে দেখছি। এখন মনে হয়, এসব কাগজের কোন দাম নাই। সব সরকারকেই ফেরত দিয়ে দিই।