আলহাজ্ব মোহাম্মদ জহিরুল হক ( জ ই বুলবুল)
ওমরাহ একটি নফল ইবাদত হলেও এর প্রতি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের একটি গভীর আকর্ষণ থাকে। কেননা এই ইবাদতে সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বহু কাক্সিক্ষত ও লালিত স্বপ্ন মহান আল্লাহতায়ালার ঘর জিয়ারত এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের দুর্লভ সুযোগ লাভ করা যায়। বিশেষ করে রমজানে ওমরাহ পালন করার মধ্যে একটি বিশেষ গুরুত্ব এবং ফজিলত রয়েছে। রমজানে একটি নফল ইবাদত একটি ফরজ ইবাদতের সমতুল্য এবং একটি ফরজ ইবাদত সত্তরটি ফরজের সমান সওয়াব লাভ করার সুযোগ রয়েছে। হাদিস শরিফে স্পষ্টই বলা আছে, রমজানে ওমরাহ করা বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে হজ করার সমমর্যাদার।
বাংলাদেশের কোনো ধর্মপ্রাণ মুসলিম রমজানে ওমরাহ পালন করে অফুরন্ত নেকি লাভের ইচ্ছা পোষণ করলে, এ বিষয়ে তাকে একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে হবে। যে কোনো ওমরাহ এজেন্সির নির্ধারিত প্যাকেজ পছন্দ করে এজেন্সির কাফেলার সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে ওমরাহ পালন করা যায়। মক্কা মদিনার হোটেল, ওমরাহ ভিসা, বিমান টিকিট, সৌদি আরবে সব ট্রান্সপোর্টেশন, খাবার, গাইড, জিয়ারাহ বা দর্শনীয় স্থানগুলো পরিদর্শন ইত্যাদি সাধারণত এই প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত থাকে।
বিশেষ করে প্যাকেজ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনার প্রাপ্য সুবিধাদির বিষয় এজেন্সির সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে প্যাকেজের বিস্তারিত লিখিতভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। তা ছাড়া আপনি নিজে শুধু ভিসা-টিকিট সংগ্রহ ও হোটেল ভাড়া করেই নিজ দায়িত্বে ওমরাহ করতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে অন্য সময়ের তুলনায় হোটেল ভাড়া, ট্রান্সপোর্টেশন, বিমান ভাড়াসহ সব খরচ রমজানে অনেক বেশি হয়ে থাকে। হজ্বের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারনে মানুষ এখন ওমরাহ মুখী হয়ে পড়ছে। যে কারণে বহু লক্ষাদিক ধর্মপ্রাণ মানুষের মিলন মেলায় মুখরিত হয়ে পড়েছে মক্কা নগরী গত জুম্মায় হারাম শরীফ থেকে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত নামাজের কাতার হতে দেখা গেছে যা এ যাৎ কালের স্মরণীয়।
যা জানা দরকার
সৌদি আরবে প্রবেশের আগে মিকাত অতিক্রম করার আগে আপনাকে এহরামের কাপড় পরিধান করতে হবে, দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হবে এবং নিয়ত করতে হবে। আপনি এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগে বাসা থেকে অথবা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম শেষ করে এয়ারপোর্টের মধ্যেই দ্বিতীয়তলায় মসজিদ রয়েছে সেখানে গিয়ে এহরাম সম্পন্ন করতে পারেন। তবে যারা বিমানে বসে সম্পন্ন করতে চান, সেখানে কিছু প্রতিকূলতা আছে। বিমানে জায়গার স্বল্পতা, অজু করা যায় না, কেবলামুখী হয়ে নামাজ পড়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। মক্কা শরিফে পৌঁছার পর ওমরাহ সম্পন্ন করাই হলো আপনার সর্বপ্রথম কাজ। আর চেষ্টা করবেন সরাসরি বিমানে যেতে,ট্রানজিট বিমানে যাতায়াত খুব বিরক্ত ও কষ্টের। এজেন্সিওয়াদের সস্তা যুক্তিতে পড়বেন না। যে আল্লাহর ঘরে যেতে ধৈর্য ধরে রাখতে হবে, ইত্যাদি নানা কথা। সব কিছু আগেই পরিস্কার হয়ে নেবেন। বিশেষ করে
রমজানে ওমরাহের তাওয়াফ ও সাঈ করার সময় প্রচণ্ড ভিড় হয়ে থাকে। সমতলে মাতাফে ভিড় পরিলক্ষিত হলে ২য় তলায় তাওয়াফ করতে পারেন। ২য় তলায় ভিড় কম থাকে, তবে তাওয়াফের এরিয়া বড় হওয়ায় আপনাকে বেশি হাঁটতে হবে। অসুস্থ বা শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য হুইল চেয়ারে তাওয়াফ-সাঈ করার ব্যবস্থা আছে। হারাম শরিফ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত হুইল চেয়ারে ওমরাহ করানোর জন্য নিয়োজিত লোক সেখানে পাওয়া যায়। তারা হুইল চেয়ার নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করেন। নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে হুইল চেয়ারের মাধ্যমে ওমরাহ করার সেবা নেওয়া যায়। যারা রমজানের এতেকাফ করার নিয়তে ওমরাহ গমন করবেন, সৌদি সরকারের হজ্ব ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়ের ঙহষরহব চড়ৎঃধষ থেকে তাদের এতেকাফের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। অন্যথায় আপনাকে এতেকাফের জন্য মসজিদে হারামে অবস্থান করতে কর্তৃপক্ষ নাও দিতে পারে। তাই আপনার ওমরাহ সার্ভিস প্রোভাইডারকে বলুন আপনার এতেকাফের রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি অনলাইনে নিশ্চিত করতে। তবে এতেকাফের শ্লট খুবই সীমিত, তাই অনলাইন পোর্টালে দ্রুত শেষ হয়ে যায়। পবিত্র মদিনায় রিয়াজুল জান্নাহতে প্রবেশের জন্য ঘটঝটক অঢ়ঢ় থেকে অবশ্যই ঝষড়ঃ ঈড়হভরৎসধঃরড়হ নিতে হবে। অন্যথায় আপনি রিয়াজুল জান্নাহতে প্রবেশ করতে পারবেন না।
ওমরাহ পালনের পাশাপাশি আপনি পবিত্র মক্কায় ইসলামিক নিদর্শন এবং হুজুর (সা)-এর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন করার সুযোগ নিতে পারেন। পবিত্র মক্কা শরিফের হজের আনুষ্ঠানিকতার মূল স্থান আরাফা, মিনা, মুজদালেফা, জাবালে রহমত, জাবালে নূর, জাবালে সূর ইত্যাদি পবিত্র স্থান পরিদর্শন করতে পারেন। তা ছাড়া মক্কা মিউজিয়াম এবং কিসওয়া বা কাবার গিলাফ তৈরির স্থান, জান্নাতুল মোয়াল্লাহ, রাসুল (সা)-এর জন্মস্থানসহ ইত্যাদি স্থান পরিদর্শন করতে পারেন। পবিত্র মদিনায় মসজিদে কোবা যেখানে ২ রাকাত নামাজ পড়লে এক ওমরাহ’র সওয়াব পাওয়া যায়, মসজিদে কেবলাতাইন, ওহুদ পাহাড়, জান্নাতুল বাকী, খন্দক ও বদরের যুদ্ধের প্রান্ত পরিদর্শন করতে পারেন। পবিত্র মক্কা শরিফে রমজানের শেষ ১০ দিন কিয়ামুল্লাইল নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। ১০ রাকাত কিয়ামুল্লাইল দীর্ঘ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আদায় করা হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়, পরম তৃপ্তি নিয়ে ও আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ধৈর্যের সঙ্গে কিয়ামুল্লাইল নামাজে শরিক হন। রমজানে ওমরাহ পালন বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কিছুটা কষ্টের। সারা বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র রমজানে ওমরাহ পালনের জন্য উদগ্রীব থাকেন। এত বেশি লোক পবিত্র মক্কা-মদিনায় একসঙ্গে একত্রিত হওয়ার কারণে স্বাভাবিক চলাচল কিছুটা সংকুচিত হয়। তাই রমজানে ওমরাহ পালন করতে চাইলে শারীরিক কষ্টের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে।
মহান রাব্বুল আলামিনের পবিত্র কাবা শরিফ ও নবী করিম (সা)-এর রওজা মোবারকে গমন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন। পবিত্র মক্কা ও মদিনা ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সর্বোৎকৃষ্ট পবিত্র স্থান। পবিত্র মক্কা-মদিনায় গমনের জন্য শৈশব থেকে যে স্বপ্ন লালন করে জীবনের একাল পর্যন্ত হৃদয়ে ধারণ করে এসেছেন আপনি, আপনার কোনো কর্ম, চিন্তা বা চলাচলে যেন মহান আল্লাহ্ বা তাঁর রাসুল (সা)-এর অসম্মান না হয়, তা সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কর্মাদি থেকে বিরত থাকা ও একমাত্র মহান আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকা এবং অন্যের কষ্টের কারণ না হওয়া। মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা, নিজের মতো করে সারেন্ডার করা, আল্লাহর মহিমা বিশালতা ও একাত্ববাদকে হৃদয়ে ধারণ করে, নিজের মনের কষ্ট-যাতনা, দুঃখ ও পরিতাপ এবং অপ্রাপ্তির কথাগুলো মহান আল্লাহর কাছে নিবেদন করা।
সারাজীবনের সব পাপ-তাপ ইত্যাদি থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা নিয়ে আমরা যেন পবিত্র রমজানে ওমরাহ পালন করে, নিষ্পাপ হয়ে দেশে ফিরে আসতে পারি এবং ভবিষ্যতে সব পাপ থেকে বিরত থাকতে পারি, সেজন্য মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করাই হোক এবারের রমজানের ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্য। তবে হজ্ব ওমরাহ পালনে অন্তত ৬ মাস আগে থেকেই এর সম্মুখ ধারণা নেওয়া প্রয়োজন কেননা বারবার হয়তো যাওয়ার সুযোগ আর বা বার বার নাও হতে পারে! তাই ওখানে কেন যাচ্ছি এর আভিধানিক অর্থ কি এগুলো জেনে বুঝেই আমাদের প্রস্তুতি রাখা ভালো।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক।