রুমন চক্রবর্তী: ধান কাটার ধুম পড়েছে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে। কড়ারোদ অগ্রাহ্য করে মাঠে ছুটছেন কৃষক। হাতে কাস্তে, মুখে হাসি। ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি ঘেমে-নেয়ে ধান কাটছেন তারা। নতুন ধানের নেশায় মাতোয়ারা সবাই। আবহাওয়া ভালো থাকায় একরে শতমন ধান হয়েছে।
সূর্যের তাপ যেন আগুনের হলকা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে গায়ে ফোসকা পড়ে অবস্থা। এই আগুনে সূর্যের নিচে মাঠভরা বোরোধান। ৮০ ভাগ পাকলেই ধান কাটার তাগিদ ছিল কৃষি বিভাগের, এই কড়ারোদ উপেক্ষা করে সেই কাজটিও করে দেখিয়েছে হাওরের কৃষক। গরমে কষ্ট হলেও আর কিছু দিন এমন রোদও চায় তারা, যেন শতভাগ ধান গোলায় উঠাতে পারে।
ইমান আলী (৬১) বাড়ির সামনে খড় শুকাচ্ছিলেন। রোদেপুড়ে গায়ের রং যেন তামাটে বর্ণের। গামছা বাঁধা মাথায় ঝরঝর করে ঘাম ঝরছিল গা থেকে। দীর্ঘক্ষণ কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার গুণধর ইউনিয়নের খয়রত গ্রামের এই কৃষকের চাষবাস বাড়ির সামনের বড় হাওরে। এবছর কেমন ধান হলো? প্রশ্ন শুনেই কুঁচকানো মুখের রেখায় রেখায় ফুটে উঠে প্রশান্তির হাসি। ‘এইবার ইচ্ছামতো ধান অইছে বাপ। চিন্তাও করি নাই এমুন ধান অইব। অক্করে ১০০ মণ।’
তিনি দেড় একর জমিতে বোরোধান চাষ করেছিলেন। কয়েক ধরণের ব্রি ধান মাঠে আছে। এগুলো এখন কাটা প্রায় শেষের দিকে। সবমিলিয়ে দেড়শ মণ ধান হবে বলেও জানালেন তিনি।
নিকলীর মজলিসপুরের কৃষক আমান উল্লাহ (৫০)। খোলা হাওরের কড়া রোদে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাই ধান কাটার ফাঁকে রোদে দাঁড়িয়েই ঢক ঢক করে ছোট কলসি থেকে পানি পান করছিলেন। তিনিও বাম্পার ফলনের কথা বললেন। তবে ধানের দাম কিছুটা কমে গেছে বলে অভিযোগ তার। মোটা ধান ৮৫০ টাকা ও চিকন ধান ৯৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন তিনি। কয়েকদিন আগেও যা ছিল হাজারের উপরে। তবু অভাবনীয় ফলন হওয়ায় খুশি এই কৃষক।
করিমগঞ্জ-নিকলীর আবদুল হামিদ সড়কের দুপাশে দিগন্তজোড়া হাওর। মাইলের পর মাইল কেবল ফসলি জমি। এ সড়কটি এখন হয়ে উঠেছে ধান শুকানো ও মাড়াইয়ের স্থান।
বাড়ির বউ-ঝি থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও দিনরাত এক করে কাজ করছেন। এমনকি বয়স্ক ব্যক্তিরাও ঘরে বসে নেই। মজলিসপুরের ধানের খলায় দেখা গেল, ছেলেদের সঙ্গে ধান মারাইয়ের কাজ করছেন জাহেরা বেগম (৭৫)। ঝাড়ু নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধানগুলো ঠিকঠাক করছেন। হাঁপ ছেড়ে সোজা হয়ে বললেন, ঘরে বইয়া থাকতে ভাল্লাগেনা, পুতাইনরা কষ্ট করতাছে আমি বইয়া থাহি ক্যামনে। রইদে কষ্ট অইলেও যতখানি ফারি করতাছি।
সেখানে কথা হয় ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী নিলুফা, মারিয়া ও লায়ামণির সঙ্গে। তারাও ধান ঝারাই-মারাইয়ে সহযোগিতা করছে পরিবারকে।
শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর জেলার হাওর উপজেলা ইটনার কয়রাকান্দা, কুনিয়ারকান্দা এবং করিমগঞ্জের সাগুলি, চংনোয়াগাঁও হাওরে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকরা ধান কাটার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। অসহ্য গরম অগ্রাহ্য করে চলছে ধান কাটা। কোথাও আবার হারভেস্টার মেশিন দিয়ে কাটা হচ্ছে ধান। এগুলো আবার শুকানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ধানের খলায়।
কয়রাকান্দা হাওরে ২০জনের ধানকাটা শ্রমিকের একটি দল ধান কাটছিল। তাদের একজন সোহরাব উদ্দিন (৩৫)। তিনি জানালেন, ১৬ কাঠা জমির ধান কাটলে তারা পাবে ২০ মণ ধান। মৌসুম শেষে এবার প্রত্যেকে ২৫ থেকে ৩০ মণ ধান বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। তিনিও জানালেন, এ বছর আবহাওয়া ভাল থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তরুণ কৃষক আলমগীর (৩০)। তিনি জানালেন, একমাত্র বঙ্গবন্ধু জাতের ধান ছাড়া ব্রি-ধান ৮৯,৯২,৯৮ এবং হাইব্রিডসহ সব ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। রসিকতা করে হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘এবার ধানের ফলনে আমরা কৃষকরা সেঞ্চুরি করেছি। একরে শত মণ ধান হয়েছে। এটি আমাদের জন্য বিরাট অর্জন বা সাফল্য বলা যায়।’
কৃষকরা জানান, ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় হাওরের বোরো ধান তলিয়ে গিয়েছিল। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে আগভাগে ধান কাটা হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব ধান কেটে ঘরে তুলতে চান তারা। এ কারণে হাওরে অন্যবারের চেয়ে ব্যস্ততা বেশি।
ধান কাটার পাশাপাশি ধানের কেনাবেচাও শুরু হয়ে গেছে। বাল্কহেড ও ইঞ্জিনচালিত নৌকায় প্রতিদিন শত শত মণ ধান আসছে করিমগঞ্জের চামড়াঘাটের আড়তগুলোতে। সেখানে কথা হয় ইটনার ছিলনি গ্রামের আব্দুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ধারকর্জ করে এবার চার একর জমিতে বোরো চাষ করেছেন। ভালো ধান হয়েছে। তবে প্রতিদিন দাম একটু করে কমছে। ঋণের টাকা পরিশোধ ও শ্রমিক খরচ মেটাতে শুরুতে কিছু ধান বেচতে হয় আমাদের। কিন্তু আড়ত মালিকরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দাম কম দিচ্ছেন। মোটা ধান বেচতে হচ্ছে ৮৫০টাকা মণ দরে। অথচ এক মণ ধান চাষে খরচ হয়েছে এক হাজার টাকারও বেশি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কৃষকরা যদি ন্যায্যমূল্য না পায়, তাহলে কৃষিকাজে আগ্রহ আর থাকবে না। কত দিন আর বঞ্চিত হবে তারা।
তবে সেখানকার আড়তদার জামাল আহমেদ বলেন, চামরাঘাট আড়তে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার ধান কেনাবেচা হচ্ছে। গতবারের চেয়ে এবার ধানের দাম বেশি পাচ্ছে কৃষক। মোটা ৮৫০ ও চিকন ধান ৯৫০টাকা মণ দরে কেনা হচ্ছে।
জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, কিশোরগঞ্জে এ মৌসুমে ১ লাখ ৬৭হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে কেবল হাওরেই আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৬২০ হেক্টর।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুস সাত্তার বললেন, এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। একরে শত মণ ফলনের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো দ্রুত কাটা হচ্ছে। দিনরাত পরিশ্রম করে কৃষকরা ধান ঘরে তুলছে। কম্বাইন্ড হারভেস্টারও নামানো হয়েছে। আবহাওয়া এখনো কৃষকের পাশে আছে বলেই তারা রোদে কষ্ট হলেও আনন্দের সঙ্গে ধান কাটতে পারছে। প্রায় ৮০ ভাগ ধান কাটা শেষ, আবহাওয়া আর কয়েকটা দিন ভাল থাকলে শতভাগ ধান কাটা শেষ হবে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।