অলোক আচার্য
হামাসের সাথে ইসরাইলের চলমান যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার মত কোনো সম্ভাবনা তৈরি না হলেও আলোচনার মাধ্যমে একটি কার্যকর যুদ্ধ বিরতিতে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কে এই গুপ্ত হামলা চালিয়েছে সে বিষয়টি নিয়ে এখনি কেউ মুখ খোলেনি।
যুক্তরাষ্ট্র এ হামলার সাথে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। আর রাশিয়া এর কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। সেই সাথে এও সতর্ক করেছে যে এতে মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থিতিশীল হতে পারে। বস্তুত বিগত সময়ে মধ্যপ্রাচ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এবং একটি বিরক্তিকর সময় পার করছে। এরই মধ্যে যখন ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় তখন থেকে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি কোনো অঞ্চলের জন্য শান্তির বার্তা আনতে পারে না।
দেশের স্বাধীনতার জন্য হামাসের একজন সক্রিয় হিসেবে আমৃত্যু তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। দিনে দিনে তিনি বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছেন। নিজেকে প্রমাণ করেছেন। সুতরাং এই মানুষটি যে হামাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য। দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘুরেছেন। থেকেছেন দেশ ছেড়ে। হারিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের। তবে হামাসের শীর্ষ নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার পর সেই আলোচনা আর কতটুকু অগ্রসর হবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। উপরন্তু ইরানের সাথে এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হামাস নিজেরাই এর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছে।
এছাড়া হামাসের মিত্র ইরান জানিয়েছে, হানিয়ার রক্তের শোধ তারা নেবে। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে কাতার থেকে তেহরানে গিয়েছিলেন হানিয়া। স্থানীয় সময় বুধবার ভোরে তেহরানের যে বাড়িতে হানিয়া ছিলেন সেখানে এক দেহরক্ষীসহ নিহত হন তিনি। ব্রিটিশ সংবামাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ইসমাইল হানিয়াকে নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে। চলতি বছর হামাসের রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন ইসমাইল হানিয়া। ২০১৭ সাল থেকে হামাসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী হানিয়া গাজা, ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং প্রবাসে হামাসের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন।
ইসমাইল হানিয়া ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে হামাসে যোগ দেওয়ার পর থেকে গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের সিনিয়র নেতা ছিলেন এবং পরবর্তী কয়েক দশকে সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে উন্নীত হন। হানিয়া গাজা, ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং প্রবাসে হামাসের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। গত দুই বছর ধরে তিনি তুরস্ক ও কাতারে বিভিন্ন সময় থেকেছেন। ১৯৯৭ সালে হামাসের মতাদর্শিক গুরুর কার্যালয়ের প্রধানের দায়িত্ব পান তিনি।
ফিলিস্তিনের জাতীয় নির্বাচনে হামাস বেশির ভাগ আসনে জয় পাওয়ার পর ২০০৬ সালে ইসমাইল হানিয়াকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। কিন্তু সপ্তাহব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর গাজায় মাহমুদ আব্বাসের দল ফাত্তাহর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হানিয়াকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুতে তিন সংগঠন হামাস, হিজবুল্লাহ এবং হুথি বিদ্রোহীরা যারা এতদিন ধরেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে ছায়া যুদ্ধ করছিল তারা আরও সক্রিয় হবে এবং সর্বাত্বক প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। আর ইরানও শক্ত অবস্থানে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট পক্ষের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বিষয়টি তদন্তাধীন। তবে আঙুল উঠেছে ইসরাইলের দিকে।
মধ্যপ্রাচ্য জ্বলার আরও কারণ হলো হানিয়া হত্যার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই বৈরুতে বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শোকরকে হত্যা করেছে ইসরাইল। দুই সংগঠনের দুই বড় নেতার মৃত্যুতে তাদের সক্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে যুদ্ধ বিরতির যে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল সে সম্ভবত আর হচ্ছে না।
হামাস দমনে ফিলিস্তিনের গাজা এবং রাফায় ইসরাইলি বাহিনীর তান্ডবে কার্যত নিজ দেশে এবং দেশের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। নিজ দেশেও বিক্ষোভ হয়েছে। এই চাপ সত্ত্বেও নেতানিয়াহু রাফায় সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। প্রশ্ন হলো ইসরাইলের এই কর্মকান্ডের ফলে ইসরাইলকে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করছেন কি না।
পরিস্থিতি এমন যে সবচেয়ে কাছের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও বন্ধুরাষ্ট্রের এই কর্মকান্ডের তীব্র সমালোচনা করছে। দশকের পর দশক ধরে চলে আসা ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মধ্যেকার অমিমাংসিত বিষয় নিয়ে চলা যুদ্ধে প্রাণহানি,সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতির তৈরি করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিরীহ ফিলিস্তিনিরা এর নির্মম শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি ইসরাইলের সাথে হামাসের সামরিক পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে। ইসরাইলের নির্মম এ অভিযানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। কোথাও নিরাপদ আশ্রয় বলে আর সেখানে কিছু নেই।
ওদিকে হামাসের সাথে ইরানের সুসম্পর্ক রয়েছে। ইরানের কাছ থেকে সাহায্য পায়। হানিয়ার গুপ্তহত্যার পর ইরানকেও নতুন কিছু ভাবতে বাধ্য করবে। কারণ ঘটনাটা তাদের দেশেই ঘটেছে। তাদের আমন্ত্রণেই সেখানে গিয়েছিলেন ইসমাইল হানিয়া। হানিয়ার মৃত্যুতে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে যা একটি স্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
sopnil.roy@gmail.com