গাজীপুরে পোল্ট্রির বায়োগ্যাসে চলছে শতাধিক পরিবারের রান্নাবান্না

রফিক সরকার : গাজীপুরের শ্রীপুরে পোল্ট্রি খামারের বিষ্ঠা থেকে উৎপাদিত বায়োগ্যাসে শতাধিক চুলায় চলছে রান্নাবান্নার কাজ।

শ্রীপুর পৌরসভার লোহাগাছ এলাকায় রাফিন পোল্ট্রি খামারে উৎপাদিত এই বায়োগ্যাস ব্যবহার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ওই প্ল্যান্টের আশপাশে ঝুলছে বায়োগ্যাস সরবরাহের পাইপ। প্রায় তিন বছর ধরে বায়োগ্যাসের সাহায্যে রান্নাবান্নার কাজ চলছে এখানে। বর্তমানে লোহাগাছ এলাকার কোনো বাড়িতে একটি আবার কোনো বাড়িতে দুটি করে ১শ ৩০টির বেশি চুলা ব্যবহার হচ্ছে।

মুরগির খামারের বর্জ্যর দুর্গন্ধের জন্য এক সময় এলাকাবাসীর কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে রাফিন পোল্ট্রি ফার্মের মালিক মোস্তাফিজুর রহমানকে। আশপাশের পরিবেশ দূষিত করার অভিযোগে বিপাকে পড়েছিলেন তিনি। ভেবে পাচ্ছিলেন না বর্জ্য কী করবেন। খামারের সেই বর্জ্যই এখন আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে এলাকাবাসীর জন্য। বর্জ্য থেকে উৎপাদিত বায়োগ্যাস জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এলাকার অনেক বাসাবাড়িতে। বায়োগ্যাস প্লান্টে ব্যবহৃত বর্জ্যর উচ্ছিষ্ট অংশ ব্যবহার হচ্ছে মাছের খাবার ও কৃষি জমির জৈব সার হিসেবে। এতে একদিকে রক্ষা হচ্ছে পরিবেশ, অন্যদিকে সাশ্রয় হয়েছে জ্বালানি খরচ।

নিজের বাসাবাড়িতেই নয়, মাসিক ১০০০ টাকায় গ্রাহকদের বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ দিচ্ছেন তিনি। এ থেকে প্রতিমাসে অন্তত লাখ টাকা আয় করছেন। এই গ্যাস সিলিন্ডার গ্যাসের চেয়ে অনেক ঝুঁকিমুক্ত এবং দামেও কম ।

বায়োগ্যাস ব্যবহারকারী আব্দুল লতিফ বলেন, আগে প্রতি মাসে ৮শ টাকা গ্যাস ভাড়া দিতে হতো। এখন দুইমাস যাবত ৯শ টাকা দিচ্ছি। বর্তমান বাজারে সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাসের যে চড়ামূল্য, বায়োগ্যাস তার চেয়ে সুলভ মূল্যে পাচ্ছি।

গৃহিনী খোরশেদা বেগম জানান, বাজারের বোতলের গ্যাসের চেয়ে এই গ্যাস অনেক ভালো। বেশিক্ষণ জ্বলে। বাজারের বোতলের গ্যাস নির্দিষ্ট সময় পর শেষ হয়ে যায়। এ গ্যাস আমরা ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস পাই। বোতল গ্যাসের চেয়ে এ গ্যাস মূল্যও কম এবং সাশ্রয় বেশি। বায়োগ্যাসের মাধ্যমে মুরগির খামারে বাচ্চা তাপ দেয়া, বাসার রান্নার কাজে ব্যবহার, জৈব সার উৎপাদন ও জেনারেটরের মাধ্যমে বাতিও জ্বালাতে পারছি আমরা।

রাফিন পোল্ট্রি ফার্মের ব্যবস্থাপক কাউসার আহমেদ জানান, আমাদের এ প্লান্ট থেকে ১৩০ টি চুলায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এলাকার লোকজনদেরকে আমরা গত তিন বছর যাবত এ সুবিধা দিচ্ছি। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে আরো ৭০ থেকে ৮০টি চুলায় সরবরাহ করার। ব্যায়োগ্যাস প্লান্টের সাথে সবসময় ৫ থেকে ৬ জন কর্মচারী কাজ করতে হয়। ব্যবহৃত বর্জ্যের উচ্ছিষ্ট অংশ আমরা জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করি এবং বিক্রিও করি। আমাদের ফার্মে প্রায় ৩৫ হাজার লেয়ার মুরগি আছে। তার মধ্যে ৩০ হাজার মুরগি ডিম দিচ্ছে। মুরগির বিষ্ঠা যত বেশি হবে গ্যাসের উৎপাদন ততো বেশি হবে।

তিনি আরো বলেন, বায়োগ্যাস উৎপাদনের পাশপাশি আমরা খামারের ব্যবহৃত গ্যালভানাইজিং খাঁচাসহ নানা উপকরণ প্রস্তুত ও সেগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছি। আগে চীন থেকে এসব আমদানি করা হতো। এখন দেশে উৎপাদন হওয়ায় দামও অনেক কম।

রাফিন পোল্ট্রি খামারের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমি ১৯৯৯ সাল থেকে এ ব্যবসার সাথে জড়িত। প্রথম আমি ২শ মুরগি নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। তখন অনেক সমস্যার সম্মুখীন হই। চিন্তা করতে থাকি একটা কিছু করতে হবে। তখন ইটকলের মাধ্যমে ছোটখাটো করে প্লান পাস করাই। এর মাধ্যমে আমার ফার্মের কর্মচারী যারা আছে তাদের রান্না বান্নার কাজ চলতো। পরে দেখলাম এটার সুযোগ সুবিধা ভালোই। পরে গত তিন বছর আগে ১৫০ ঘন মিটারের প্লান করি। খরচ হয় প্রায় ১৬ লাখ টাকা। প্রথমে এলাকার ৭৬টি বাসা-বাড়িতে সংযোগ দেই। সংযোগ দেওয়ার পর প্রথমদিকে যারা ব্যবহার করছে তারা সবাই খুব খুশি। এ বায়োগ্যাসের প্রতি উদ্ভুদ্ধ হয়ে আশেপাশের লোকজনও আমার কাছ থেকে বায়োগ্যাসের সংযোগ নেয়।

তাদের কাছ থেকে প্রথমে আমি সংযোগ ফি ১০০০ টাকা এবং মাসিক ৮০০ টাকা নেই। বর্তমানে ৯০০ টাকা নিচ্ছি প্রতি মাসে। আমি তাদেরকে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহ করছি। দিন দিন গ্যাসের প্রেসার ভালো থাকায় এবং আমার কাছ থেকে ভালো সার্ভিস পাওয়ায় এলাকাবাসী আমার কাছে দাবী করে সবাইকে এ সংযোগ দেওয়ার জন্য। পরে তাদের অনুরোধে আমি আরো ৭৬টি লাইন করে সর্বমোট ১৩০টি বাসা-বাড়িতে বায়োগ্যাসের সংযোগ দিয়েছি। ভবিষ্যতে আশপাশের আরো বাসাবাড়িতে গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার ইচ্ছে আছে। সব মিলিয়ে আমার টার্গেট হলো ২০০ পরিবারের মধ্যে বায়েগ্যাস সরবরাহ করবো।

শ্রীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের ভেটেরিনারি সার্জন আলী আকবর বলেন, যাদের হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা বা গরুর খামার রয়েছে তারা বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করছে। তাদের দ্বারা আশপাশের মানুষ উপকৃত হচ্ছে। আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস লিমিটেড। কিন্তু হাঁস মুরগীর বিষ্ঠা থেকে উৎপাদিত গ্যাস আনলিমিটেড ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কমছে।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts