জীবনকে সুস্থতার জন্যই হাত ধোয়া জরুরি

 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 

আজ মঙ্গলবার বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস ২০২৪।প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সকলের হাত সুরক্ষিত থাক’।

 হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। শরীরের এক মিলিমিটার লোমকূপের গোড়ায় প্রায় ৫০ হাজার জীবাণু থাকতে পারে। এসব জীবাণু খালি চোখে দেখা যায় না। তাই হাত দিয়ে যখন আমরা মুখে খাবার পৌঁছে দেই অথবা নাকে হাত দেই, তখন সেই হাতই হয়ে উঠতে পারে জীবাণু ছড়ানোর ভয়ংকর মাধ্যম-যদি তা অপরিষ্কার হয়। সারাদিন আমরা হাত দিয়ে কত কিছু স্পর্শ করি। তাই হাতে লেগে থাকতে পারে অনেক মারাত্মক জীবাণু। এ কারণে হাত ধোয়া খুবই দরকার।বিশ্বব্যাপী আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম ২০০৮ সালের এই দিনে সুইডেনে হাত ধোয়া দিবসটি উদযাপিত হয়। পরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তারিখটি প্রতি বছর পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ যাতে হাত ধোয়াকে জীবনযাপনের অংশ করে নেয়, অভ্যস্ত হয়, সে জন্যই পালিত হয়ে আসছে এ বিশেষ দিবস।

বিশ্ব হাতধোয়া দিবসের মূল লক্ষ্য হলো,

১. সমাজের সব স্তরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার একটি সাধারণ সংস্কৃতির সমর্থন ও প্রচলন করা। 

২. প্রতিটি দেশে হাত ধোয়ার বিষয়ের নজর দেয়া। 

৩. সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

হাত পরিষ্কার করার অভ্যাস প্রত্যেকটি মানুষের থাকা দরকার। জীবনকে সুস্থতার জন্যই জরুরি হাত ধোয়া। তবে মানুষের মাঝে হাত ধোয়া প্রবণতা খুব কম দেখা যায়। যা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য কখনও কাম্য নয়। প্রতিটি কাজের পর হাত ধোয়া খুব জরুরি প্রয়োজন। খাওয়ার শুরুতে হাত ধোয়া দরকার, ঠিক তেমনি খাবার বানাতে বা পরিবেশন করতেও হাত ধোয়া জরুরি। খাবার বা যে কোনও কাজ শেষ করার পর হাত ধোয়া এবং হাত ধুয়ে মোছার তোয়ালেটাও পরিষ্কার থাকা উচিত। এখন সাবান সহজলভ্য। তাই মাটি বা ছাই নয় অবশ্যই সাবান ও পরিষ্কার পানি দিয়ে হাত ধোয়া উচিত সবার।

যে কোনো রোগ প্রতিরোধে হাত ধোয়ার ভূমিকা এখন শুধু হাসপাতালে সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রেস্তোরাঁ সবস্থানেই স্বীকৃত। হাত ভালোভাবে না ধুয়ে খাদ্য খেলে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও অন্যান্য জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে।

যে সয়ম হাত ধোয়া উচিত:

১. খাওয়ার আগে

২. অসুস্থ কারও সেবা করার আগে এবং পরে

৩. খাবার তৈরি কারার আগে ও পরে

৪. পায়খানা প্রস্রাবের পরে

৫. শিশুর ডায়পার বদলানো বা পায়খানা পরিষ্কারের পর

৭. দেহের কাটাছেঁড়া বা ক্ষতের চিকিৎসা করার আগে এবং পরে

৮. পোষা জীবজন্তুর খাবার ধরার পরে

৯. বাহির থেকে কাজ শেষ করে ঘরে প্রবেশ করার আগে

১০. নাক ঝাড়া বা কফ ফেলা এবং হাঁচি দেবার পরে

১১. আবর্জনা ধরার পরে

১২. যে কোন জিনিসে হাত দেওয়ার পর

> কোন উপায়ে হাত ধোয়া উচিত

১. পরিষ্কার পানিতে হাত ভেজাতে হবে সাবান দিয়ে

২. দুহাত ঘষে ফেনা তৈরি করতে হবে, আঙ্গুলের ফাকে, নখের মাঝে পরিষ্কার করা

৩. ২০ সেকেণ্ড সময় ধরে হাত পরিষ্কার করা

৪. পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে

> হাত ধোয়ার কারণে যে কোন রোগ জীবাণু থেকে সহজে রক্ষা পাওয়া যায়।

 এমন অন্যান্য সময়গুলিও থাকতে পারে যখন হাত ধোয়া গুরুত্বপূর্ণ।

সঠিক উপায়ে আপনার হাত ধোওয়ার জন্য পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করুন

আপনার হাত ধোওয়া সহজ এবং এটি রোগ জীবাণু ছড়ানো প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায়গুলোর অন্যতম। পরিষ্কার হাত এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে এবং সমগ্র কমিউনিটিতে—আপনার বাসা ও কর্মস্থল থেকে শুরু করে শিশু পরিচর্যা ব্যবস্থাপনা ও হাসপাতালে জীবাণু ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে পারে।

সবসময় নিচের পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করুন-

* পরিষ্কার, প্রবাহমান পানি (গরম বা ঠাণ্ডা) দ্বারা আপনার হাত ভেজান, কল বন্ধ করুন এবং সাবান লাগান।

* সাবান দিয়ে ঘষে আপনার হাতে সাবানের ফেনা করুন। আপনার হাতের পৃষ্ঠদেশ, আঙুলের মাঝে এবং নখের নিচে ফেনা করুন।

* অন্তত ২০ সেকেন্ডের জন্য আপনার হাত ঘষুন 

* পরিস্কার প্রবাহমান জল দিয়ে আপনার হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিন

* একটি পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে বা বাতাসে আপনার হাত শুকিয়ে নিন

আপনি যখন সাবান ও পানি ব্যবহার করতে পারবেন না তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন

সাবান ও পানি পাওয়া না গেলে আপনি একটি অ্যালকোহল ভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন যাতে কমপক্ষে 60% অ্যালকোহল থাকে।

অধিকাংশ পরিস্থিতিতে জীবাণু থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোওয়া। যদি সাবান ও পানি সচরাচর পাওয়া না যায় তাহলে আপনি একটি অ্যালকোহল-ভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারেন যাতে কমপক্ষে 60% অ্যালকোহল থাকে। পণ্যের লেবেল দেখে আপনি জানতে পারবেন স্যানিটাইজারটিতে ৬০% অ্যালকোহল আছে কিনা।

> অনেক পরিস্থিতিতে স্যানিটাইজার হাত থেকে দ্রুত জীবাণু দূর করতে পারে। তবে, স্যানিটাইজার সব ধরনের জীবাণু থেকে মুক্ত করে না।

হাতে দৃশ্যমান ময়লা বা তেল/চর্বি থাকলে তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার তেমন কার্যকর নাও হতে পারে।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাত থেকে কীটনাশক ও ভারী ধাতুর মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক দূর করতে পারে না।

> হ্যান্ড স্যানিটাইজার কীভাবে ব্যবহার করবেন

সাবধান! অ্যালকোহল-ভিত্তিক হ্যান্ড স্যানিটাইজার গিলে ফেললে অ্যালকোহল জনিত বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে যদি একাধিক বার মুখভর্তি করে গেলা হয়। এটি শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন এবং তাদের ব্যবহার তদারক করুন।

> হাত ধোয়া হোক জীবনাচারের অংশ:-আজ ৪ বছর যাবৎ করোনাভাইরাস আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটি কোনো বিচ্ছিন্ন চর্চা নয়; বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এ চর্চা অন্তর্ভুক্তির সময় এসেছে। নিয়ম মেনে হাত না ধোয়ার কারণে যেসব সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ধাকে, সেসব বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালাই শুধু নয়, তা বাস্তবায়নের ‍দিকে নজর দিতে হবে।

> জেনে নিন

কাঁচা মাংস, মুরগি, সামুদ্রিক খাবার বা ডিম স্পর্শ করার পরে হাত ধোয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অন্যান্য খাবারে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে সঠিকভাবে হাত না ধুলে। ইউএসডিএ’র ফুড সেফটি অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসের একটি গবেষণা বলছে, ৯৫ শতাংশের বেশি সময় ভুলভাবে হাত ধোয় রাঁধুনিরা। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায় মারাত্মকভাবে। 

> হাত ধোয়ার উপকারীতা:-

* হাতের ব্যবহার বেশি- তাই হাতে অনেক রকম জীবাণু লেগে থাকে। * হাত থেকে মুখে চোখে নাকের ভেতর দিয়ে জীবাণু মানবদেহে প্রবেশ করে। * ঘটায় রোগ। * হাত থেকে ছড়াচ্ছে কাপড়চোপড় আসবাবপত্রে। * হাত থেকে ছড়ায় অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে। ছড়ায় খাদ্যবাহিত রোগগুলো। * হাত ধোয়ার তাই এত গুরুত্ব। * হ্যাঁ, সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে অন্তত ২০ সেকেন্ড। * প্রতিবছর ১.৮ ট্রিলিয়ন বাচ্চা সারা পৃথিবীতে মারা যায় ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগে। * হাত ধুলে ৪০ শতাংশ ডায়রিয়াজনিত মৃত্যু ও ৩০ শতাংশ নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যু কমে যাবে। * এ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হাত ধোয়া অনেকাংশে কমিয়ে দিতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, হাত ধোয়া নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আগের দিনে মানুষ জন এত সচেতন ছিল না। এতে তাদের রোগবালাইও ছিল বেশ। শুধু হাত ধুলেই কিন্তু অনেক রোগবালাই থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। পেটের পীড়া থেকে শুরু করে সর্দিজ্বর অনেক কিছুই হাত ধোয়ার সাথে জড়িত।

আমাদের দেশে এক সময় স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব ছিল। এখন এ অবস্থার উন্নতি হলেও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলোতে এখনো স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব বেশ।আর বাংলাদেশে বর্তমানে  প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষকে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন এবং নিরাপদ পানির উৎসের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে, ২০০৩ সালে যা ছিল মাত্র ৩৩ শতাংশ। অপরদিকে খোলা স্থানে মলত্যাগকারীর হার ২০০৩ সালের ৪৪ শতাংশ থেকে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের এ সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে সকলের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সেবা নিশ্চিত করা।করোনা ভাইরাসসহ অন্যান্য মহামারি ও রোগব্যাধি থেকে সুরক্ষাসহ এসকল রোগব্যাধির বিস্তার রোধে সবচেয়ে সহজ, সাশ্রয়ী ও কার্যকর উপায়গুলোর একটি হলো সাবান ও পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়া এবং নিরাপদ স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো সঠিকভবে মেনে চলা। এসব মানুষকে সচেতন করতে ১৫ অক্টোবর পালন করা হয় বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস।

লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক। প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি 

ইমেইল, drmazed96@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts