এমপি লিটন হত্যায় ৭ জনের ফাঁসি, যেভাবে কিলিং মিশন

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আব্দুল কাদের খানসহ সাতজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।

আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে গাইবান্ধার জেলা ও দায়রা জজ দিলীপ কুমার ভৌমিকের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, একই আসনের জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও সাংসদ আবদুল কাদের খান, তাঁর খানের একান্ত সচিব (পিএস) শামসুজ্জোহা, গাড়িচালক আবদুল হান্নান, গৃহকর্মী শাহীন মিয়া, মেহেদী হাসান, আনোয়ারুল ইসলাম রানা ও চন্দন কুমার সরকার।

রায়ের সময় ছয় আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। চার্জশিটে অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে একজন কারাগারে মারা গেছেন এবং একজন পলাতক রয়েছেন।

এর আগে গত ১৯ নভেম্বর গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি খণ্ডন শেষে রায়ের দিন ধার্য করেন বিচারক।

২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গার মাস্টারপাড়ার নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। এ ঘটনায় অজ্ঞাত পাঁচ-ছয় জনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করেন লিটনের বড় বোন ফাহমিদা কাকলী বুলবুল।

তদন্ত শেষে এই হত্যা মামলায় কাদের খানসহ আট জনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

 

কুড়িয়ে পাওয়া ম্যাগজিনের সূত্র ধরে বের হলো লিটন হত্যার রহস্য

 

দীর্ঘ এক বছরের পরিকল্পনায় ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ আসনের সরকার দলীয় এমপি লিটনকে। পেশাদার খুনির বদলে ভাড়া করা হয়েছিল হতদরিদ্র ঘরের তিন যুবককে। বিভিন্ন প্রলোভনে কর্নেল (অব:) ডা. আব্দুল কাদের খান নিজেই তাদের ৬ মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে সফল ভাবে শেষ করেছিলেন এই কিলিং মিশন।

সংবাদ সম্মেলনে সুন্দরগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি আতিয়ার রহমান জানান, বিগত ২০১৬ সালের গত ১ ডিসেম্বর দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কের ধোপাডাঙ্গার নয়া বাজার এলাকায় ফাহিম নামে এক যুবকের একটি মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় ছিনতাইকারীরা তাড়াহুড়ো করে পালাতে গিয়ে অসাবধানতা বশত: ৬টি গুলিসহ একটি ম্যাগজিন ফেলে রেখে যায়। সোনারায় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ বদিরুল আহসান বিষয়টি স্মরণ করে দেওয়ায় পর পরীক্ষা করে দেখা যায় এমপি লিটনের শরীর থেকে অপারেশন করে বের করা গুলি এবং তার বাড়িতে হত্যার পর প্রাপ্ত গুলির খোসার সঙ্গে কুড়িয়ে পাওয়া ওই ম্যাগাজিনের গুলির মিল রয়েছে। পরে ওই সূত্র ধরে ৫২ দিন পর এমপি লিটন হত্যার মূল রহস্য বের হতে শুরু হয়।

তিনি জানান, ওই সূত্র ধরে সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশ কাদের খাঁনের লাইসেন্সকৃত পিস্তল ও গুলি থানায় জমা দিতে বলে। কিন্তু কাদের খান মোট চল্লিশ রাউন্ড গুলির মধ্যে মাত্র ১০ রাউন্ড থানায় জমা দেন। বাকি গুলিগুলো কি করলেন এমন প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব তিনি দিতে পারেননি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সুন্দরগঞ্জ থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আবু হায়দার মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, মোবাইল ছিনতাইকারী রানা, মেহেদী ও শাহিনকে শনাক্ত করা হয়। কয়েক দিন পর পুলিশ জানতে পারে, এই তিনজনের সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলেন কাদের খান। একদিন কথোপকথনের সময় কাদের খান বলেন, সুন্দরগঞ্জ আসনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পাওয়া ব্যারিস্টার শামীম হোসেন পাটোয়ারীকে সরিয়ে দিতে হবে। গাইবান্ধার পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনজনই প্রথমে এ কাজে রাজি হননি। তখন তিনি (কাদের খান) সুন্দরগঞ্জের ঘটনার চেয়ে এ ঘটনা অনেক সহজ বলে জানান। এই কথাবার্তাই কাদেরের জন্য কাল হয়ে যায়।

ওসি আতিয়ার রহমান আরও জানান, লিটনকে হত্যার পর জাতীয় পার্টির (এরশাদ) রওশন এরশাদ ঘেঁষা এই নেতা (কাদের খান) ওই আসনের উপ নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করলেও শেষ পর্যন্ত জমা দেন নাই। কারণ জাপার চেয়ারম্যান এরশাদ সম্প্রতি সুন্দরগঞ্জের এক জনসভায় উপ-নির্বাচনে তার দল জাতীয় পার্টি থেকে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মনোনয়ন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ফলে নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারায় তাকেও (ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী) হত্যার পরিকল্পনা করেন কাদের খান।

বিগত ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভোর রাতে জেলা শহরের ব্রিজ রোড এলাকা থেকে শাহীন মিয়া (২৫) ও মেহেদী হাসান (২৪) এবং তার গাড়ীর চালক আব্দুল হান্নানকে (২৭) আটক করে পুলিশ। পরে তারা পুলিশের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন।

ডিইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, লিটনকে সরিয়ে দিতে পারলেই পুনরায় ওই আসনে কর্নেল কাদের আবারও এমপি নির্বাচিত হবেন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, উচ্চাভিলাষ, লোভ ও ক্ষমতার মোহেই সাবেক এমপি কাদের খান গত এক বছর থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনা করেন।

ওসি আতিয়ার রহমান জানান, ঢাকা থেকে গাইবান্ধা আসার পথে বগুড়ায় এমপি লিটনকে গত অক্টোবর মাসে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তায় প্রথমে তার গাড়িতে পেছন থেকে ধাক্কা দিলে লিটন বের হয়ে আসা মাত্রই তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত করতে পারেনি।

কর্নেল কাদের খাঁনের গাড়িচালক আবদুল হান্নান হত্যাকাণ্ডে কিলারদের পালিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করেন।

ওসি আতিয়ার রহমান বলেন, কাদের এই কিলারদের এ পর্যন্ত ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন। এমপি হওয়ার পর তাদের গাড়ি-বাড়িসহ আরও অনেক কিছু করে দেওয়ার প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, শুধু তাই নয় জামায়াত অধ্যুষিত সুন্দরগঞ্জের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটাতে কর্নেল কাদের তার লোক দিয়ে এক বছর আগে থেকে ছিনতাই, মন্দিরের মূর্তি ভাংচুর, অপহরণসহ একের পর এক নানা অপকর্ম ঘটান যাতে এই খুনের দায় জঙ্গি কিংবা জামায়াতের ঘাড়ে পরে। সুযোগ খুঁজতে থাকেন এমপি লিটনকে গুলি করে হত্যা করার। শেষ ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এমপি লিটনের নিজ বাড়িতে তাকে গুলি করে হত্যা করতে সক্ষম কাদের খান।

Print Friendly

Related Posts