জড়জীবন নয়, চাওয়া হোক মানবজীবন

ফাহিমা নিপা
.
বিশ্ব নারী দিবস— যে দিবস এলে স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে আমাদের নারী এবং তাদের যাপিত জীবনের কথা; তখন মনে হয়, এ দিবস আমাদের বৃহত্তর নারীদের জন্যে নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর কারণ অনেক, বর্ণনায় শেষ করার মতো না।
ইদানীং একটি বিষয় প্রায়ই চোখে আঙুল দেয়; সেটি হলো বিয়ের স্টেইজে সেজেগুজে বসা কনের আশপাশবর্তী অনেক হবুকনের হাতে বড় পর্দার মোবাইল ফোন। সেটি আবার যেনতেন ব্র্যান্ডের নয়— অধিকাংশ স্টিভ জবসের আইফোন; আইফোন ইলেভেন বা আইফোন এক্স। তেমন একটি ফোন হাতে নিয়ে সম্প্রতি এক বিবাহের অনুষ্ঠানে আসা একজন তরুণীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— এতো অত্যাধুনিক ফোন দিয়ে কী করেন? জবাবে তিনি বললেন— ‘এই তো ফটো তুলি, সেলফি তুলি, টিকটকক করি, প্রিয়জনের সাথে অডিও ভিডিও কল করি।’ কথায় কথায় জানতে পারলাম যে, বিদেশ থেকে আসার পর এ ফোনটি এ্যাকটিভ করতে তিনি অন্যের সাহায্য নিয়েছেন এবং ইমেইল সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই! ইনবক্স বলতে তিনি জানেন ফেইসবুকের ইনবক্স! জানা গেলো আরো— তিনি বিবাহিত এবং প্রবাসী স্বামী হওয়ায় তিনি খুব শিগগির ইউরোপে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে যাচ্ছেন। এবং তিনি ছোটোবেলা থেকে ইউরোপের জীবন পছন্দ করেন; সেসব দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের স্বপ্ন অনেক পুরনো। যদিও বাংলা ছাড়া তিনি অন্য কোনো ভাষা জানেন না। তবে তিনি বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েট!
কথা হলো— এ নারী ইউরোপে এসে কী করবেন বা কেমন করে চলবেন! কারণ, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে আসা নারীদের আশি থেকে নব্বই শতাংশই গৃহজীবী— সন্তান উৎপাদন, তাদের লালন পালন এবং প্রাত্যহিক গৃহস্থকর্ম সম্পাাদনের মধ্যদিয়েই কেটে যায় তাদের গৃহবন্দিজীবন বা সারাজীবন! যে স্বপ্ন দীর্ঘদিন লালন করেছিলেন মনের ঘরে, স্বামীর ঘরে এস সে স্বপ্নকে কবর দিতে হয়! আর এ জন্যে মূলত এবং প্রধানত দায়ী ওই নারী নিজেই। কারণ, বিদেশে অচল পয়সার উপমা তিনি। তার চেয়ে দুঃখের কথা হচ্ছে— ওই শ্রেণীর নারীদের আরেকটি বড়ো অংশ হচ্ছেন তারা যাদের মধ্যে অচল ও সচলের বোধই জাগ্রত নেই! এবং তাদেরই সার্বিক অবস্থা বেশি শোচনীয়।
আমি তো দেখেছি সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতেও অনেক নারী ভয় পান। কারণ, স্কুলে গেলে তার সন্তানের উন্নতি কিংবা অনুন্নতির অনেক তথ্য শিক্ষকদের নিকট থেকে জানতে হয় এবং সে সবের ভালোমন্দ জবাব দিতে হয়; যে কাজে তারা অপারগ! আমি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে অনেক বাংলাদেশী এবং এশিয়ান নারীকে দেখেছি, যারা স্মার্টফোন ইউজ করেন, বছরে একাধিকবার ফোন বদলান, অথচ ওই ফোন দিয়ে ডাক্তারের জন্যে একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে পারেন না, ওই ফোন দিয়ে এম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার ব্রিগেড ডাকতে পারেন না! এসব তড়িতবিপদেও তাদেরকে অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়! অথচ, তাদেরই মুঠোয় সারাক্ষণ বন্দি থাকে আইফোন ইলেভেন বা আইফোন এক্স! তখন আমি তাদেরকে তাদেরই মুঠোবন্দি জড়পদার্থ ফোনের সাথে তুলনা করি— হাজারো কাজে সক্ষম হলেও ওই অত্যাধুনিক ফোন দিয়ে তিনি শুধু ফটোই তুলেন, সেলফি তুলেন, টিকটক করেন এবং তাদের পক্ষেও হাজারো কাজ করার ক্ষমতা থাকলেও তারা শুধু সন্তান উৎপাদন করেন এবং গৃহস্থকর্মই সম্পাদন করেন রুটিন মাফিক! হায়, এটি কোনো জীবন নয়, এমন প্রকার জীবন মানুষের নয়।
আমাদের নারীদের একটি বড়ো অংশেরই এই জীবনবোধ নেই! জীবন বলতে তারা বুঝেন— ভালো খাওয়া, ভালো পরা, শাড়ি গাড়ি বাড়ি। অথচ, এ সবের যোগানে তাদের অধিকাংশের কোনো ভূমিকা নেই! শতভাগ স্বামীনির্ভর জীবন কখনো জীবন হতে পারে না। এ প্রকার জীবনে একপ্রকার সুখ থাকে বটে কিন্তু রামধনু সুখ থাকে না। এ প্রকার জীবন বন্দি টিয়া শালিক ময়না কিংবা আদুরে বিড়াল অথবা সারমেয়র জীবনের মতোই— ভালো ভালো খাদ্য, আদর ভালোবাসা, চিকিৎসা এবং নিরাপত্তা মিলে যায় বটে কিন্তু জীবন তাদের খাঁচামুক্ত বা গৃহমুক্ত হয় না কখনো।
আমাদের নারীদের আরেক অংশ আছেন যারা সম-অধিকার চান অথবা সম-অধিকার নিয়ে খুবই সোচ্চার। অথচ, তাদেরই এক বড়ো অংশ পিতার ভাণ্ডারে স্বস্থি খোঁজেন অথবা স্বামীর ঘাঁড়ে চড়ে দুচোখ বুঁজেন। কথা হচ্ছে— কথায় নয়, সম-অধিকার নিশ্চিত করতে নারীদেরকে পুরুষের সমকক্ষ হতে হবে। প্রাচীনযুগ ও মধ্যযুগের গোড়ামী আর বর্বরতার কথা বাদ দেন, ভুলে যান! ঝাড়ু মারেন আমাদের দাদীনানীর পুরুষপূজার মন্ত্রে! শুধু সুযোগ্য হোন! একুশ শতকে সুযোগ্য হবার কোনো বিকল্প নেই। সমান সুযোগ্য না-হয়ে, সমান ক্ষমতায় বলীয়ান না-হয়ে, সমান তালে না-চলে সমান অধিকার দাবি করা বড়োই বেমানান নয় কি? অস্বীকার করা যাবে না— পৃথিবী চালায় পুরুষ। হ্যাঁ, এজন্যে লাখ লাখ বছরের পুরুষতন্ত্রকে আমরা দায়ী করতে পারি। কিন্তু আমরা যদি ওই দায়ী করার মধ্যেই আমাদের তাবৎ ক্ষোভ বন্দি করে ফেলি তাহলে আমরা ওই প্রবাসী স্বামীর সুন্দরী স্ত্রীর মুঠোয় বন্দি আইফোনের মতো কেয়ামত পর্যন্ত খাঁচাবন্দি পাখি ও গৃহবন্দি প্যাটের জীবনই যাপন করবো; যা কখনোই কাঙ্ক্ষিত নয়, যা মানবজন্মের পক্ষে যায় না কখনো। আমরা মনেপ্রাণে চাই একটি ফলদজীবন, সুফলা মানবজন্ম।
মনে পড়ে সপ্তম শতকের ভারতীয় নারী দার্শনিক গার্গীর কথা— পুরুষ পণ্ডিতেরা যার ঘাঁড় থেকে মুণ্ডু বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছিলো শুধুমাত্র তার বুদ্ধিমত্তায় ভয়ার্ত হয়েই। তিনি তাদের হুমকিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ঘরের কোণে বসে থাকেন নি: তার অভ্যন্তরীণ আলোয় তখনকার সমাজে আলো ছড়িয়েছেন একজন অধম্য সাহসী সমাজসংস্কারক হিশেবে। আর এ কারণে দেড় হাজার বছর পরও তিনি পৃথিবীর বুকে বেঁচে আছেন একটি বাতিঘরের মতোই। আমরাও চাই আমাদের নারীরা তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন ও প্রতিষ্ঠায় পারিবারিক সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রিক ভয় উপেক্ষা করবেন গার্গির মতো।
৮ মার্চ, ২০২০।। প্যারিস, ফ্রান্স।
Print Friendly

Related Posts