লিবিয়ায় গুলি করে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা যেভাবে

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশিসহ মোট ৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাকি চারজন আফ্রিকান নাগরিক। স্থানীয় এক মানবপাচারকারীর পরিবারের সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। পাচারকারীরা ত্রিপলী থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে তাদের হত্যা করে।

লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই ঘটনায় আরও ১১ জন বাংলাদেশি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। দেশটির ইংরেজি গণমাধ্যম দ্য লিবিয়া অবজারভার বৃহস্পতিবার রাত পৌনে নয়টার দিকে তাদের ফেইসবুক পেজে জানায়, নিহত বাংলাদেশিরা মিজদা শহরে ওই মানবপাচারকারীর জিম্মায় ছিলেন। তাকে আগেই হত্যা করা হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, এই সকল অভিবাসী মিজদা শহরের এক মানাবপাচারকারীর কাছে জিম্মি ছিলেন। কোনভাবে ওই পাচারকারী গত রাতে অভিবাসীদের হাতে খুন হন। পরে পাচারকারীর সহযোগী এবং আত্মীয়স্বজনরা জিম্মি অভিবাসীদের ক্যাম্পে নির্বিচারে গুলি চালালে ঘটনাস্থলে ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৩০ জন মারা যায়।

ত্রিপলিতে বাংলাদেশ দূতাবাস বিষয়টি নিশ্চিত করে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনী বাংলাদেশীদের উপর এলোপাতাড়ি গুলি চালালে আনুমানিক ২৬ (ছাব্বিশ) জন বাংলাদেশী নিহত হন। তার মধ্যে এক জন প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশীর সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে দূতাবাস সংবাদটি নিশ্চিত করে। তিনি কোনো প্রকারে প্রাণে বেঁচে এখন এক হৃদয়বান লিবিয়ানের আশ্রয়ে আত্মগোপন করে আছেন।

তিনি দূতাবাসকে জানান, ১৫ দিন আগে বেনগাজী থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে কাজের সন্ধানে মানবপাচারকারীরা তাদেরকে লিবিয়ার ত্রিপলী শহরে নিয়ে আসার পথে তিনিসহ মোট ৩৮ বাংলাদেশী মিজ্দাহ শহরে তাদের জিম্মি করা হয়। জিম্মি অবস্থায় তাদেরকে অত্যাচার, নির্যাতন করার একপর্যায়ে অপহৃতরা মূল অপহরণকারী লিবিয়ান ব্যক্তিকে হত্যা করে। তারই জের হিসেবে অন্যান্য দুষ্কৃতিকারীরা আকষ্মিকভাবে তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে, আর তাতে ২৬ বাংলাদেশী নিহত হয়। যাদের মৃতদেহ মিজদাহ হাসপাতালে সংরক্ষিত আছে। অবশিষ্ট বাংলাদেশীরা হাতে-পায়ে, বুকে-পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

মিজদাহ হাসপাতালের পরিচালক টেলিফোনে এ বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানান, ওই মরদেহগুলো বর্তমানে মিজদাহ হাসপাতালের মর্গে পরিবর্তী প্রক্রিয়ার জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। অন্যদিকে দূতাবাসের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারাও ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন এবং উক্ত মৃতদেহ সমূহের বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান।

ঘটনায় আহত অন্তত ১১ জন বাংলাদেশীদেরকে জিনতান হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে অধিকতর উন্নত চিকিৎসার জন্য ত্রিপলী মেডিকেল সেন্টারে (টিএমসি) প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বিবিসি জানায়, হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন আহত বাংলাদেশি নাগরিকের বয়ানের ভিত্তিতে লিবিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম বিষয়ক কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম জানান, মারা যাওয়া ২৬ জন সহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি ও কিছু সুদানি নাগরিক প্রায় ১৫ দিন ধরে ঐ অপহরণকারী চক্রের হাতে আটক ছিলেন। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদায় আটক করে রাখা হয়েছিল তাদের। সেখানেই ২৮শে মে সকালে বন্দীদের ওপর গুলি চালায় অপহরণকারীরা।

মূলত ইতালিতে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে ঐ ৩৮ জন বাংলাদেশি লিবিয়ায় গিয়েছিলেন। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত জটিলতা শুরু হওয়ার আগে ডিসেম্বর মাসে তারা ভারত ও দুবাই হয়ে বেনগাজি বিমানবন্দরে পৌঁছান। এরপর গত কয়েক মাস তাদেরকে লিবিয়ার ভেতরে গোপনে রাখা হয়েছিল। উপকূলীয় অঞ্চল যুওয়ারা হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে ইতালির দিকে যাত্রা করার পরিকল্পনা ছিল পাচারকারীদের।

বছরের এই সময়টায় সাগর অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকায় এটিকেই সাগর পাড়ি দেয়ার আদর্শ সময় বলে মনে করা হয়। কিন্তু প্রচলিত ও ব্যবহৃত পথে না গিয়ে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে বেশ বিপদসংকুল একটি পথে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল,” বলেন আশরাফুল ইসলাম।

তিনি বলেন যুদ্ধকবলিত লিবিয়ায় একাধিক সরকার থাকায় ত্রিপলি হয়ে যুওয়ারা যাওয়ার প্রচলিত পথে নানা রকম তল্লাশি হয়। সেই পথ এড়িয়ে কম ব্যবহৃত মরুভূমির মধ্যকার রাস্তা দিয়ে অভিবাসীদের নিয়ে যুওয়ারা যাচ্ছিলেন পাচারকারীরা। কিন্তু ঐ মরুভূমির পথ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণাধীন, যারা সরকারহীনতার সুযোগ নিয়ে অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে অনেকদিন ধরে। সন্ত্রাসী ও অপহরণকারীদের একাধিক গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের ঘটনাও ঘটে থাকে।

আশরাফুল ইসলাম জানান, বেনগাজি থেকে মরুভূমির রাস্তায় যুওয়ারা যাওয়ার পথে তারা অপহরণকারীদের কবলে পড়েন। অপহরণের পর মিজদাতেই প্রায় ১৫ দিন অপহরণকারীদের জিম্মায় ছিলেন অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশি ও সুদানি নাগরিকরা। অপহরণকারীদের সাথে আটক হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তিপণ নিয়ে দর কষাকষি চলছিল। আটককৃতদের অনেকেই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলেও কাঙ্ক্ষিত মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হয় তারা । মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আাটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে অপহরণকারীরা। এক পর্যায়ে বাংলাদেশিদের সাথে থাকা সুদানি নাগরিকরা অপহরণকারী চক্রের এক সদস্যকে মেরে ফেলেন। এরপর অপহরণকারীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালালে ৩৮ জন বাংলাদেশির সবাই গুলিবিদ্ধ হয়। মারা যায় ২৬ জন।

গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় কয়েকজন ভিতরেই পড়ে ছিল, দুই-একজন আহত অবস্থায় বের হয়ে আসে। তাদের দেখে স্থানীয় লোকজন সেনাবাহিনীকে খবর দেয় এবং সেনাবাহিনী তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। আহত বাংলাদেশিদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে লিবিয়ার একটি সংবাদ মাধ্যম আল-ওয়াসাত খবর প্রকাশ করেছে যে মোহাম্মদ আব্দুল রহমান, যিনি একজন মানব পাচারকারী হিসেবে পরিচিত, অজানা কারণে শুরু হওয়া এক ‘বিদ্রোহে’ মারা যান। এরপর তার পরিবারের সদস্যরা ঐ ভবনটি ঘেরাও করে এবং মরদেহ ফিরে পাওয়ার জন্য আলোচনা শুরু করে।

এক পর্যায়ে ঐ ভবনে উপস্থিত ১০০ জন অভিবাসী আত্মসমর্পণ করেন, কিন্তু ৪০ জন ভবন ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। এরপর ঐ ভবনে ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও রকেট দিয়ে হামলা করার পর ভবনের ভেতরে থাকা ব্যক্তিরা নিহত হন। তবে অন্য কোন সূত্র থেকে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

Print Friendly

Related Posts