পল্লী বিদ্যুতে বিকলাঙ্গ ‘ডে লেবার’: খোঁজ রাখেনা কেউ

ফারুক আলম: কারো হাত উড়ে গেছে। কারো পুরো শরীরে প্লাস্টিক সার্জারি। কেউ হাতের সার্জারির জন্য কাজ করতে পারেন না। কারো পেটের মধ্যে তিন ইঞ্চি ডিপে প্লাস্টিক সার্জারি করা।

মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে এসেছে এসব মানুষ। হাসপাতালের বিছানায় কেটেছে মাসের পর মাস। এখনো শরীরে ব্যাথা, মনে ৪০ ফুট উপর থেকে পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক। আধমরা এসব মানুষ এখন বেকার। অনেকেই ৪০ ফুটের সেই সব খুঁটি থেকে পড়ে চলে গেছেন পরপারে। মৃত মানুষদের পরিবার আর আধমরা মানুষগুলোর খোঁজ রাখেনা কেউ। তাদের কাজ ফুরিয়েছে। তারা এখন অপ্রয়োজনীয়।

খোদ খোঁজ রাখে না পল্লী বিদ্যুতও, যে প্রতিষ্ঠানের কাজে তাদের এই দুরাবস্থা। এমন অসংখ্য মানুষের প্রতি ন্যূনতম মানবিকতা দেখায়নি প্রতিষ্ঠানটি। অবাক করার মত তথ্য হচ্ছে, এদের পিছনে খরচ করার জন্য অফিসিয়ালি কোনো ফান্ডই নাই। একটি টাকাও প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করেনা ‘ডে লেবার’ হিসাবে নিয়োগ করা এসব খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। অথচ এরা সবাই পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে জীবন হারিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, দুঃসহ যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।তবুও এদের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির কিছুই করার নেই-সাফ কথা!একটাকারও ফান্ড নেই।

অথচ এখনো রাত দিন, ঝড় ঝঞ্ঝায় এদেরকেই ডেকে নিয়ে খুটিতে চরিয়ে দেওয়া হয়। লাইন মেরামত করা হয়। সারাদিন অক্লান্ত শ্রমের বিনিময়ে পায় ৩০০ টাকা। এভাবেই চলছে পল্লী বিদ্যুতের ‘ডে লেবার’দের জীবন। এদের না আছে বেতন-পরিচয় পত্র, না আছে ঝুঁকির বিপরীতে ন্যূনতম নিশ্চয়তা।

শ্রমজীবি এসব মানুষদের প্রতিদিনের কাজের বিপরীতে নিয়োগ করা হয়। কাজ শেষে বিদায়। এদের নিয়োগ করেন অফিসের লাইনম্যান, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার।

আদিতমারী জোনাল অফিসের লাইনম্যান ফিরোজ ২০২০ সালের জুন মাসে বাড়ি থেকে ডেকে নেন রাশেদুল ইসলামকে। আদিতমারী এলাকার একটি খুঁটিতে তুলে দেন। সেই খুঁটির কাজ শেষে নেমে পড়েন রাশেদুল। তিনটা খুঁটির পরে আর একটি খুঁটিতে ওঠার নির্দেশ দেন। খুঁটিতে যেতে ১০ মিনিটের পথ। এর মধ্যে সাবস্টেশন থেকে লাইন চালু করে নেন লাইনম্যান ফিরোজ। রাশেদুলকে খুঁটিতে চরার পরে অন্যমনস্ক ফিরোজ লাইনের শাটডাউন (লাইন বন্ধ) চান নাই সাবস্টেশন খেকে। রাশেদুল খুঁটিতে চরে লাইনে হাত দেওয়ার সাথে সাথে বিকট শব্দে মাটিতে পড়ে যান।আগুন জ্বলে ওঠে। শরীর পুড়ে যায়। পেটের মাংস, ঘাড়ের মাংস, বগলের মাংস উড়ে যায় ৫০ ফুট দূরে। দ্রুত রংপুর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করানো হয়। সেখানে অচেতন রাশেদুলের চিকিৎসা চলে এক বছর। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে ২ বছর ধরে যন্ত্রণাকাতর বেকার জীবন পার করছেন রাশেদুল।

রাশেদুল বলেন, আমি শুনেছি আমার মৃত্যুর খবর শুনে আমার বউয়ের নামে একাউন্ট করে ফিরোজ বস। আদিতমারী জনতা ব্যাংকের একাউন্ট নম্বর ০১০০২১৪১৬১৩৭৫। যেখানে এপর্যন্ত একটি টাকাও জমা হয়নি। টাকা জমার কথা বলে আমার কাছে সই নিয়েছে কাগজে। সাহায্যের কথা বলে সই নিয়েছে তদন্ত দল। প্রায় দুই বছর হতে চললো। আমি কোনো কাজ করে জীবন চালাবো এর উপায় নেই। ফিরোজ বসের সাথে একাধিক দিন আমার এলাকার লোকজন কথা বলেছে, তিনি এখন পাত্তা দেন না।

এ ব্যাপারে তৎকালীন এজিএম বর্তমানে টাঙ্গাইল পল্লী বিদ্যুতের এলেঙ্গার ডিজিএম একেএম সফিউল আলম বলেন, আমি ঘটনার পরেই বদলি হয়ে যাই। ফিরোজের ব্যাক্তিগতভাবে তাকে হেল্প করার কথা। আমি নিজে রাশেদুল, গনেশকে হেল্প করেছি। অফিসে একটি দরখাস্ত করা ছিলো। এখন যারা আছে, তাদের কাছে একটু খোঁজ নিবেন। ফিরোজ, ইনচার্জ রফিকুল দায়িত্বে ছিলো। এরা সমস্যার সমাধান করার কথা। আমি থাকলে সমাধান হতো।

একই স্টেশনে স্বপদে বহাল থাকা লাইনম্যান ফিরোজ বলেন, আমার কোনো কথা হয়নি রাশেদুলের সাথে। রাশেদুলকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেইনি। কেনো দিবো, তাকে অফিস নিয়েছে। অফিস দেখবে। আমি তার পিছনে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছি। এর হিসাব আমার কাছে আছে।

তবে, আজকাল পরশু করে ফিরোজ ২৬ দিন পরেও কোনো তার হিসাবের কাগজ দেখাননি। পরে তিনি বলেন, ডিজিএম স্যার কোনো ডকুমেন্ট বা কথা বলতে নিষেধ করেছেন। অবশ্য ডিজিএম ফিরোজের এই বক্তব্য নাকচ করেছেন।

পল্লী বিদ্যুতের ডে লেবার আর ইলেক্ট্রেশিয়ান বানি, পিপলু, শ্যামলসহ অনেকেই বলছেন, রাশেদুলকে সেদিন ফিরোজ নিয়ে গেছে। তারপর তো শুনি রাশেদুল মারাই গেছে। তখনকার এজিএম আর আমরা সব ইলেকট্রিশিয়ান মিলে রাশেদুলের চিকিৎসা করেছি। এখানে ফিরোজ কোনো টাকা দেয়নি। সে তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলো। আমাদের মাধ্যমে রাশেদুলের বউয়ের নামে এ্যাকাউন্ট করে। দুই লক্ষ টাকা রাশেদুলের বউয়ের নামে দেওয়ার কথা ছিলো। সেই টাকাও দেয় নাই।

গনেশ চন্দ্র নামের একজন বলেন, আমি মাত্র খুঁটিতে চরেছি। লাইনে হাত দিলাম। পরে আর কিছু বলতে পারিনা। ৪ দিন পর জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালের বিছানায়। আমার একটা হাত নাই। রাশেদুলসহ আমাদেরকে বলেছিলো, আমাদের জন্য কিছু একটা করবে। কিন্তু কিছুই করে নাই। আমার সন্তানরা লেখাপড়া করে। সংসার আছে। আমি বেকার।নিজেকে অসহায় লাগে। কিছুই করতে পারিনা।

আয়নাল হক জানান, আমার ভাই শনিবার (১৭ এপ্রিল) সন্ধ্যায় উপজেলার সারপুকুর ইউনিয়নের মুসর দৌলজর গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটিতে চরার সাথে সাথেই আগুন ধরে মারা যায়। এই ঘটনায় ১ লক্ষ টাকা অফিসের লোকজন একাউন্টে জমা করে দিয়েছে।

ডিজিএম (দায়িত্বপ্রাপ্ত জিএম, কুড়িগ্রাম লালমনিরহাট পল্লী বিদ্যুত সমিতি) বলেন, খুঁটিতে ওঠার জন্য আমরা কোনো ডে লেবার নেইনা। খুঁটিতে চরার জন্য নেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। এসব কাজ লাইনম্যানরাই করবে। কিছু কাজের জন্য নেই, তাও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোকদের। ফিরোজকে ডকুমেন্ট হিসাব না দেওয়ার কথা বলিনি। ওর জায়গা থেকে আমার সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবে কি করে। আমার সাথে ফিরোজের কথা হয়নি। আমার দায়িত্বে কোনো অনিয়ম হতে দেবো না।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts