চলচ্চিত্র পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পাওয়ার পর মন্ত্রণালয়টির দপ্তর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানো হয়েছে।
১২ নভেম্বর রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে এ তথ্য জানান কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লতিফুল ইসলাম শিবলী। তিনি লেখেন, গতকালের ছবিতে যারা আমাদের মাথার উপর শেখ মুজিবের ছবি দেখেছেন, তাদের জানার জন্য বলছি যে, ফারুকী আজ তার অফিস তথা সংস্কৃতি মন্ত্রলায় থেকে ফ্যাসিবাদের আইকন শেখ মুজিবের ছবি সরিয়ে ফেলেছেন । সম্ভবত সচিবালয়ে এই কাজ ফারুকীই প্রথম করলেন । দায়িত্বপ্রাপ্ত ফারুকির মধ্যে আমি সেই স্পিরিট দেখেছি,সে আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে ইনশাল্লাহ ।
উপদেষ্টা হওয়ার পর মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীকে নিয়ে সমালোচনার বিষয়ে শিবলী লেখেন, ফারুকী দোষেগুণে মেশানো একজন মানুষ। এই মন্ত্রণালয় চালানোর যোগ্যতা তার আছে। অতীতে তার ফ্যাসিবাদের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষির যেমন প্রমাণ আছে, তেমনি তাদের বিরোধিতা করারও প্রমাণ আছে। আমি খুব ভালো করেই জানি আওয়ামী ফ্যাসিসদের দ্বারা সে কেমন নিগৃহীত হয়েছে।
তিনি বলেন, জুলাইয়ের তীব্র দিনগুলোতে আমরা যখন অসহায়ের মতো দেশের সেলেব্রিটি বুদ্ধিজীবীদের সমর্থনের আশায় তাকিয়ে ছিলাম, তখন দু-একজন ছাড়া আর কাউকে আমাদের পাশে পাইনি। সেই জুলাইয়ে দু-একজনের মধ্যে ফারুকী ছিলেন একজন। ফারুকীর সেই সময়ের স্ট্যাটাসগুলো অনেক তরুণকে সাহস জুগিয়েছে।
এদিকে বঙ্গভবনের দরবার হল ছাড়াও সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তর থেকেও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানো হয়েছে।
সোমবার ও মঙ্গলবার সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তর থেকে বঙ্গবন্ধুর অন্তত ছয়টি ছবি সরানো হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সচিবালয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়ার দপ্তরে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নেই।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের দপ্তর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানো হয়েছে বলে জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফ বিল্লাহ জানান। অন্তর্বর্তী সরকারের নতুন বস্ত্র ও পাট এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিন শপথ নেওয়ার পর সোমবার সচিবালয়ে যান। এই উপদেষ্টা আসার আগেই তার দপ্তর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের সরিয়ে ফেলা হয়।
সবার আগে ১১ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনের দরবার হল থেকে শেখ মুজিবের রহমানের ছবি সরানো হয়। ছবিটি সরানোর কথা প্রথমে জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের নবনিযুক্ত উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এ নিয়ে ১৩ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন মাহফুজ আলম। তার স্ট্যাটাসটি পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
শেখ মুজিব ও তার কন্যা (আরেক শেখ) তাদের ফ্যাসিবাদী শাসনের জন্য জনগণের তীব্র রাগ-ক্ষোভের মুখে পড়েছেন। তাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হলো, শেখ মুজিব একসময় পূর্ব বাংলার গণমানুষের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, যে জনপ্রিয়তা হাসিনার ছিল না। জনগণ পাকিস্তানি নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার (শেখ মুজিব) নেতৃত্ব অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু ‘৭১-এর পর তিনি নিজেই একজন অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। মুজিববাদের প্রতি তার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য ১৯৭১ এর পর বাংলাদেশ পঙ্গু ও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। নিজের ফ্যাসিবাদী ভূমিকার কারণে ১৯৭৫ সালে তার মৃত্যুতে মানুষ শোক প্রকাশ করেনি। তবে, শেখ তার ‘৭১ সালের আগের ভূমিকার জন্য সম্মান পাবেন, যদি শেখের ‘৭১-এর পরবর্তী গণহত্যা, জোরপূর্বক গুম, দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ ও নিশ্চিতভাবেই ‘৭২-এর সংবিধান, যা বাকশাল প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেছিল-এসবের জন্য তার দল ও পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চান। শেখের কন্যার ফ্যাসিবাদী শাসনের কথাও তাদের স্বীকার করা, ক্ষমা চাওয়া এবং এ জন্য বিচারের মুখোমুখি হওয়া উচিত (তিনি শেখ মুজিবকে একজন ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও উপহাসের পাত্র বানিয়েছিলেন)। তাদের উচিত, মুজিববাদী রাজনীতি ও শেখ পরিবারের বন্দনা পরিহার করা। কন্যার ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে শেখের ছবি সরানো হয়েছে (কর্মকর্তারা সরিয়েছেন, যদিও তা হয়েছে); যে শাসন মেয়ে করেছেন ফ্যাসিবাদী বাবার নামে ও তার ‘৭১-পরবর্তী চেতনার কথা বলে। তার বাবাকে দেবতুল্য করা হয়েছিল, কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের মানুষ একসঙ্গে তাদের দুজনের ছবি, ম্যুরাল ও ভাস্কর্য নামিয়ে ফেলেছেন।
বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরানো নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, মুজিবের ছবি সরিয়ে দেয়া উচিৎ হয়নি। বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামানো ঠিক হয়নি। খন্দকার মোশতাকও তার ছবি নামিয়েছিলেন আর জিয়াউর রহমান আবার টাঙিয়েছিলেন সেই ছবি। পরে অবশ্য বক্তব্যের সংশোধনী দিয়েছেন। বলেন, আমি মনে করেছিলাম, বঙ্গভবনের দরবার কক্ষে যেখানে সব রাষ্ট্রপতির ছবি থাকে সেখান থেকে শেখ মুজিবের ছবি নামানো হয়েছে। মূলত: ছবিটি সরানো হয়েছিল বঙ্গভবনের অন্য একটি অফিস কক্ষ থেকে। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে শেখ মুজিবের ছবি রাখার বাধ্যতামূলক আইন করা হয়েছে। ফ্যাসিবাদী আইনের কোনো কার্যকারিতা থাকতে পারে না। অফিস-আদালত সর্বত্রই দুঃশাসনের চিহ্ন রাখা উচিত নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যের জন্য আমি দুঃখিত।