ফিতরা পাওয়ার প্রথম হকদার হচ্ছেন একান্ত নিকটাত্মীয় গরিবেরা; অতঃপর দূরাত্মীয়, পাড়াপ্রতিবেশী, মিসকিন, নওমুসলিম, ঋণভারে জর্জরিত ব্যক্তি এবং সাময়িক আর্থিক সঙ্কটে পতিত ব্যক্তিরা। হাদিসগুলো থেকে জানা যায়, মহানবী সা: যেসব খাদ্যদ্রব্যকে ফিতরা আদায়ের মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করেছেন তা হচ্ছে- গম বা আটা, যব বা বার্লি, খেজুর, কিশমিশ ও পনির।
ইমাম মালেক ও আহমদ রহ:-এর মতে খেজুর, ইমাম শাফিঈ রহ:-এর মতে গম এবং ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতে উক্ত পাঁচটি দ্রব্যের মধ্যে যেটির বাজার দর সর্বোচ্চ তা দিয়ে ফিতরা আদায় করা সর্বোত্তম। মহানবী সা: ধনী গরিব সবাইকে ফিতরা আদায় করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা ফিতরা দাও। আল্লাহ তোমাদের অনেক গুণ বেশি দান করবেন’ (আল হাদিস)।
দুই বছর ধরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গমসহ সব ফিতরাযোগ্য খাদ্যদ্রব্যের উল্লেখ করে প্রতিটির বাজার দর অনুযায়ী ফিতরা ঘোষণা করে আসছে। ইসলামি ফাউন্ডেশনের এই মহতী উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সর্বসাধারণের একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, শুধু গম বা এর মূল্যই ফিতরা হিসেবে আদায় করা যায়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জনগণের এই অজ্ঞতা দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে সর্ব মহলে প্রশংসিত হচ্ছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক ঘোষিত এবারকার (১৪৩৭ হি:, ২০১৬ খ্রি:) মাথা পিছু ফিতরার পরিমাণ- গম অর্ধ ছা (১.৬৫০ গ্রাম) নগদ অর্থে ৬৫ টাকা; যব বা বার্লি এক ছা (৩.৩৩০ গ্রাম) নগদ অর্থে ২০০ টাকা, কিশমিশ এক ছা ১০০০ টাকা, খেজুর এক ছা ১৫০০ টাকা, পনির এক ছা ১৬৫০ টাকা।
উল্লেখ্য, গমের ক্ষেত্রে দু’টি বিকল্প ব্যবস্থা আছে : এক ছা অথবা অর্ধ ছা। এক ছা হিসেবে মাথাপিছু ফিতরা হবে ১৩০ টাকা।
আল্লাহ তায়ালা যাকে যেরূপ আর্থিক সামর্থ্য দান করেছেন তার তদানুসারে দান-খয়রাত করা উচিত। একজন দিনমজুর বা নির্মাণ শ্রমিক যদি ৬৫ টাকা ফিতরা দেন এবং একজন ধনী ব্যক্তিও যদি তাই দেন তবে সেটা মোটেই ইনসাফপূর্ণ ও মানবিক দান হলো না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধনী লোকেরা যেন তাদের সামর্থ্য অনুসারে ব্যয় করে এবং যার সম্পদ সীমিত সে যেন আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকেই ব্যয় করে’ (সূরা তালাক : ৭)।
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা রোজগার করো এবং আমি ভূমি থেকে তোমাদের জন্য যা উৎপন্ন করি, তার উৎকৃষ্ট অংশ দান করো এবং এর নিকৃষ্ট অংশ ব্যয় করার ইচ্ছা পোষণ করো না; অথচ তোমরা তা (নিকৃষ্টটি) গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নও’ (সূরা বাকারা : ২৬৭)।
একটি ভুল ধারণা
কিছু লোক বলে থাকেন যে, গমের ক্ষেত্রে অর্ধ ছা মহানবী সা: নির্ধারণ করেননি, বরং আমিরে মুয়াবিয়া রা: তাঁর রাজত্বকালে এর প্রবর্তন করেন। এ কথা ঠিক নয়। বরং মহানবী সা: থেকেই গম সম্পর্কে দুই ধরনের (অর্ধ ছা এবং ১ ছা) বক্তব্য সম্বলিত হাদিস বিদ্যমান রয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে সা’লাবা রা: বলেন, মহানবী সা: ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে লোকজনের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন, ‘তোমরা প্রতি দু’জনের পক্ষ থেকে এক ছা গম অথবা আটা আদায় করো অথবা মাথাপিছু এক ছা খেজুর অথবা এক ছা বার্লি প্রত্যেক স্বাধীন, গোলাম, নাবালেগ ও বালেগের পক্ষ থেকে আদায় করো’ (মুসনাদ আহমদ ও আবু দাউদ)।
ইবনে আব্বাস রা: বসরার গভর্নর থাকাকালে লোকজনের উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা তোমাদের রোজার জাকাত আদায় করো। এতে লোকজন পরস্পরের দিকে তাকাতে থাকে। তিনি বললেন, এখানে মদিনাবাসী কে কে আছে? তোমরা দাঁড়াও তোমাদের ভাইদের সামনে। কেননা তারা জানে না যে, মহানবী সা: সদাকাতুল ফিতর বাধ্যতামূলক করেছেন প্রত্যেক ছোট-বড়, স্বাধীন-গোলাম এবং নারী-পুরুষের ওপর-অর্ধ ছা গম অথবা এক ছা খেজুর অথবা বার্লি (আবু দাউদ, নাসায়ি)।
ইবনে আব্বাস রা: আরো বলেন, মহানবী সা: এই সদাকা (ফিতরা) এক ছা বার্লি অথবা এক ছা খুরমা অথবা অর্ধ ছা গম নির্ধারণ করেছেন’ (মুসনাদ আহমদ)।
হজরত আবু বকর রা:-এর কন্যা আছমা রা: বলেন, ‘আমরা মহানবী সা:-এর যুগে ফিতরা বাবদ দুই মুদ গম আদায় করতাম, যে মুদ দ্বারা তোমরা খাদ্যশস্য মেপে থাকো’ (মুসনাদ আহমদ)।
নগদ অর্থে ফিতরা
পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র নগদ অর্থে ফিতরা প্রদান একটি প্রচলিত প্রথা (উরফ) হয়ে গেছে। ফিতরার প্রাপকেরাও নগদ অর্থ পেলেই অধিক আনন্দিত হন। উপরন্তু তারা নগদ অর্থের মাধ্যমে সহজেই নিজেদের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন। এ ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা শরিয়তে জায়েজ। ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, তোমাদের সঙ্কটে নিক্ষেপ করতে চান না’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। মহানবী সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই দ্বীন সহজসাধ্য’ (বুখারি, নাসায়ি, মুসনাদ আহমাদ)।
কোনো ব্যক্তি সঙ্গত ওজরবশত রোজা রাখতে না পারার কারণে তাকে ফিদিয়া আদায় করতে হয়। এ জন্য একজন মিসকিনকে দুইবেলা রান্না করা খাবারও তার বাড়িতে ডেকে এনে আহার করাতে পারেন অথবা খাবারের মূল্য নির্ধারণ করে নগদ অর্থও প্রদান করতে পারেন। নগদ অর্থে ফিতরা আদায়ের বিষয়টিও অনুরূপ।