মেট্রো নিউজ ।। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের ৬৭তম জন্মদিন আজ। সাড়ম্বরে তার জন্মদিন পালন হচ্ছে অনেক জায়গায়। একটা অনলাইন চ্যানেল তাকে নিয়ে সারাদিন জন্মদিনের অনুষ্ঠান করছে। হিমু পরিবহন সারাদেশে পালন করছে তার জন্মদিন। তাদের শুরুটা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে, তাদের উদ্যোগে শিশু ক্যান্সার রোগীদের ফ্রি কেমো আর রক্তদান কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন দুটি পুরস্কারও দিচ্ছে সাহিত্যে। হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার একটি পাঁচ লাখ টাকা অন্যটি এক লাখ টাকা। দুটি ছবি মুক্তি পাচ্ছে তার জন্মদিনে। তার কাহিনি নিয়েই তৈরি এই দুই ছবি। তারপর চ্যানেল আই-এর হিমু মেলা তো আছেই, তাকে ঘিরে কত না আয়োজন…।
কিন্তু যে ছোট্ট বেলায় তার জন্মদিন হওয়ার দরকার ছিল সেটা কিন্তু কখনও হয় নি। তখন তো এ রকম জন্মদিন পালনের ব্যাপারগুলোই ছিল না। সে খুব যখন ছোট ছিল আমার মা টাইফয়েড হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সে তখন একা একা থাকত আমার নানীর কাছে। নানীর বুকের দুধ খেয়েই সে বড় হয়েছে। এ জন্য নানী ছিলেন তার দুধ মা। মার কাছে শুনেছি। মা যখন সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন নানার বাড়িতে তখন সে দূর থেকে মাকে লক্ষ্য করত, কাছে আসত না। গাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে মাকে দেখত। মা ডাকতেন কিন্তু কাছে আসত না। হয়ত সে ভাবত এই অপরিচিতা মহিলাটি তার মা? সেই ছোট্ট হুমায়ূনের জন্মদিন পালনের কথা তখন কেউ কি ভেবেছিল? না সম্ভব ছিল?
আজ এত বছর পর যখন পেছনের দিকে তাকাই তখন এই বিষয়গুলো চিন্তা করে কি অদ্ভুত নষ্টালজিয়া আমাদের গ্রাস করে। সত্যি জীবন আশ্চর্য রকমের নির্লিপ্ত। তারপরও জীবন চলছে। হুমায়ূন আহমেদ এখন থমকে গেছে জন্মদিন আর মৃত্যুদিন এই দুটি দিন পালনের মধ্যে।
বিখ্যাত মানুষেরা যুগে যুগে বলে গেছেন, মানুষ তার কর্মের ভেতর টিকে থাকবে। কর্মই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়ত তাই। কিন্তু যে মানুষ হুমায়ূন আহমেদকে আমরা আর কোথাও দেখি না, যে বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদকে আর কোথাও দেখি না, তার অভাব পূরণ করবে কে?
সে যখন ছিল, প্রতি জন্মদিনে সে মজার মজার কাণ্ড করত। একবার তার জন্মদিনে কেক কাটা হবে, কেক ফ্রিজ থেকে বের করার পর দেখা গেল সেই কেক গলে গিয়ে একেবারে জলবৎ তরলং অবস্থা। হয়ত করেন্ট ছিল না, বা কিছু একটা হয়েছে। বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করেছে এখন কেক কাটা হবে কীভাবে? বড় ভাই ঘোষণা দিল কোনো ব্যাপার না, এবার কেক কাটা হবে না। কাপে করে খাওয়া হবে তরল কেক। শেষ পর্যন্ত তাই হলো, কাপে ঢেলে ঢেলে কেক খাওয়া হলো। এ-ও আরেক মজা!
আমাদের পরিবারের সমস্ত আনন্দের উৎস ছিল সে। হুটহাট করে সে প্রোগ্রাম করে বসত। একবার হুট করে সকালে আমার বাসায় গাড়ি নিয়ে হাজির। তখন আমি সদ্য বিয়ে করেছি। থাকি কল্যাণপুরের এক ভাড়া বাসায়। এসে বলল, রেডি হ আমি ময়মনসিংহ যাচ্ছি। তোরা আমার সাথে চল, রীতাকে রেডি হতে বল। আমি আমার বউ দুজনেই পুরো অপ্রস্তুত। এখন হুট করে ময়মনসিংহ যাই কীভাবে? সঙ্গে ভাবি আর তার তিন কন্যা । কি আর করা তড়িঘড়ি করে রওনা হলাম তার সাথে। ময়মনসিংহ গিয়ে অবশ্য মজাই হলো। সেখান থেকে গেলাম নানার বাড়ি ট্রেনে। দুদিন থেকে ফিরে এসে আমাকে আমার বাসায় নামিয়ে দিল। বলল, ‘তোর খরচ কত হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘কিসের খরচ?’
‘এই যে ট্রেনের টিকিট কাটলি।’
সে এ রকমই কাউকে কোনো খরচ করতে দিত না। সব আনন্দের খরচ বহন করত সে একা।
সেই আনন্দের মানুষটা এখন সত্যিই একা। একদম একা শুয়ে আছে নুহাশ পল্লীর লিচু বাগানে। সেই বাগানে প্রচুর লিচু ধরে। স্ইে লিচু আবার মানুষ খেতে পারবে না, তার নির্দেশ ঐ বাগানের লিচু খাবে বাদুর আর পাখী। এখনও সন্ধ্যায় তারা তাকে ঘিরে কিচির মিচির করে। কে জানে হয়ত তাদের ভাষায় তাকে কৃতজ্ঞতা জানায়। মানুষ কখনও কখনও অকৃতজ্ঞ কিন্তু পশু-পাখী কখনও নয়। শুভ জন্মদিন দাদাভাই!