ইদ্রিস মাদ্রাজী ।।
[১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর। রমজান মাস। বৃহস্পতিবার। ভোলা জেলার (তৎকালীন বরিশাল জেলার ভোলা মহকুমা) চারফ্যাসন উপজেলার চরমাদ্রাজ ইউনিয়নের চরআফজাল গ্রাম। এই গ্রামের ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে বেড়ি বাধহীন বঙ্গোপ সাগর। আর ৬ কিলোমিটার পূর্বে উত্তাল মেঘনা। সেই গ্রামে ১২ নভেম্বরের জলোচ্ছ্বাস ও কালরাত জয়ী ৭ বছরের এক শিশুর বেঁচে থাকার গল্প।]
দু’দিন আগে থেকেই ঈষাণ কোন হতে বইছে থেমে থেমে দমকা বাতাস। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সূর্যের দেখা নেই ৩ দিন। আজ বাতাসের তীব্রতা প্রচণ্ড। সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বাতাসের তীব্রতায় বৃষ্টির ফোটাগুলো হেচকা মেরে দুরে চলে যায়। আছড়ে পড়ে খোলা দরজা বা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে। বিদ্যুৎচমকানী বা মেঘের কোন ঘনঘটা নেই, তবে আকাশ প্রচণ্ড গোমরামুখো, বুঝে ওঠার উপায় নেই কি ঘটবে আজ।
এলাকার মানুষের এই ধরণের অভিজ্ঞতা প্রতি বছরই দু’চার বার আসে। তাই এমন পরিস্থিতিতে তেমন আতঙ্কিত নয় অনেকেই। সবাই জানে সাগরে নিম্নচাপ আছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উপকূলে ৩ নম্বর বিপদ সংকেত। প্রচণ্ড দমকা হাওয়া, অবিরাম বর্ষণ ও শীতে সব যবুথবু। আব্বা, আম্মাসহ দুই ভাই ও এক বোন নিয়ে ৫ সদস্যের সংসার আমাদের। ছোট বোনের বয়স ৪। ছায়া-সুনীবির, বন-বনানীতে ঘেরা বাগান-বাড়ীর মতোই আমাদের নিজের বাড়ি। বিকেলের পর থেকে আকাশের অবস্থা আজ ভয়ংকর। রমজান মাস হওয়ায় ঘরে বসেই ইফতার হলো, নামাজ হলো। এমনিতেই চললো সময়। আবহাওয়া উন্নতির লক্ষণ নেই।
সন্ধ্যা হয়েছে ঘণ্টা খানেক। বাতাস ও বৃষ্টির তীব্রতা বেড়েই চলেছে। মা বলেছিলেন পরিস্থিতি বেশি ভাল নয়। কোথাও চলে যেতে, বাধ সাধলেন আব্বা। নিজেদের বাড়ি, গাছপালা, ঘর, মালপত্র, গরু-ছাগল, হাস-মুরগী, আসবাবপত্র রেখে কোথায় যাবে। এই ঝড়ের রাতে এগুলোর অবস্থা কি হবে। যা হবে এখানেই থাকবো। তাই আর যাওয়া হলো না। সারাদিন ছাতা নিয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করা গেলেও সন্ধ্যার আগে থেকে সবাই গৃহবন্দী। আব্বা খুব দুর্দান্ত সহসী। তাই একাই লড়তে লাগলেন ঝড়ের সাথে।
২৫ বন্ধের ঘর, উত্তর ভিটায়-দক্ষিণ মুখো। উঠোন ও রান্নাঘর বরাবর অর্থাৎ দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে টানা বারান্দা। ছনের ছাঊনী, খলফার বেড়া। রাজা-শাইল ধান কাটা হয়েছে ঘরে ঘরে, আমাদেরও-তাই উঠোনে আটি আটি বাধা গোল করে রাখা রাজা-শাইল ধানের মস্ত গোলা। কালো মেঘ, রাত, প্রচণ্ড বৃষ্টি, তীব্র বাতাস এসবের তণ্ডব বাইরে। তাই বাইরের কিছুই দেখা যায় না। সোয়া পাচটায় সন্ধ্যে হলেও তখন রাত সাড়ে আটটার কম নয়। আব্বা তখোনো লড়ছিলেন ঝড়ের সাথে। ঘরের কার্নিস দিয়ে, বেড়ার নীচে দিয়ে, জানালা খুলে গিয়ে হেচকি মেরে বৃষ্টির পানি ঢুকছিল ঘরের ভেতর। তাই পলিথিন বা অন্য কিছু দিয়ে সেগুলো প্রতিরোধের চেষ্টা করছিলেন আব্বা সেই সন্ধ্যা থেকেই।
আমার বয়স তখন সাত। ঝড় কি তা বোঝার উপায় ছিল না। ছোট থাকায় হয়তো ঝড় মোকাবেলার জন্য আমাকে প্রয়োজন হয়নি আব্বার। আমি বোনকে নিয়ে কাঠের চৌকিতে। শোবার জন্য হাত-পা ধুয়ে চৌকিতে আছি। ইফতারের সময়ই রাতের খাবার খেয়েছি। রাত এখন ৯টা।
বৃষ্টির পানি পড়ে ছাগলের খোয়াড়ে ছানা দুটো মারা যেতে পারে সে ভয়ে মা ওদেরকে ঘরে নিয়ে এসেছে। আমাদের খাটের কাছে পুরোনো কাপড় মোচা করে তার ওপরে এনে বসিয়ে রেখেছে ছানা দুটো। ১৩ দিন বয়সী ওই দুটি ছানাকে ফিডারের বোতলে গরুর দুধ খাওয়াচ্ছিলাম আমি আর বোন মাহমুদা। ছানা দুটো জন্মের ৪ দিনের মাথায় বাড়ির পশ্চিমে আমাদেরই বিশেষ ধরণের ধান গাছের বিষাক্ত পাতা খেয়ে মা ছাগলটা মারা যায়। তার পর থেকে এই ছানা দুটোকে এভাবেই দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা প্রতিদিন। রাত তখন ন’টা। ঝড়ের বেগ প্রচণ্ড বেড়েছে। এই ঝড় যে কাল রাতের ঝড়ে রূপ নিচ্ছে টের পেলাম অব্বা-আম্মার হুলুস্থুল দেখে।
ইতিমধ্যে বসত ঘরখানা দক্ষিণ-পূর্ব কোন থেকে আসা বৃষ্টি আর বাতাসের তোড়ে অনেকটা হেলে গেছে। বারান্দায় রাখা কয়েকটা অতিরিক্ত খুটি বাঁকা-খাড়া করে ঠেক দিয়ে ঘরটিকে সোজা রাখার চেষ্টা করছেন আব্বা আর আম্মা। সাথে ১০ বছর বয়সী ভাই ইসমাইলকে ডেকে নিয়েছেন ঠেক দেয়া দু-একটি খুটি ধরে রাখতে। কাঠের খুটি ঠেক দিয়ে বেঁধে বেঁধে ঘরটিকে সোজা করে রাখার চেষ্টা করছেন তারা। এভাবেই ঘণ্টা খানেক চলে তাদের যুদ্ধ। কিন্ত সবি ভেস্তে যায়।
বাইরের মুশল ধারার বৃষ্টি, প্রচণ্ড দমকা হাওয়া ততক্ষণে ৬০ ডিগ্রি কোনে পশ্চিম-উত্তর দিকে কাত করে ফেলেছে ঘরটিকে। ঠিক তখনি রান্না ঘরের সাথে খোয়াড়ে থাকা ৩টি ছাগল চিৎকার করতে থাকে। আব্বার টর্চ লাইটটি নিয়ে মা রান্না ঘরের দিকে ছুটে যান ছাগলগুলো দেখতে। মা রান্না ঘরে গিয়ে টর্চ মেরে দেখেন ছাগলের খোয়াড়ের ভেতর ৬ ইঞ্চি পরিমান পানি এবং লক্ষ্য করলেন রান্না ঘর ও বসত ঘরের মাঝে দিয়ে প্রায় আর্ধ হাটু পরিমাণ পানি প্রচণ্ড স্রোতের বেগে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে যাচ্ছে। আম্মা বুঝতে পারলেন এ পানি বৃষ্টির নয়, সাগরের। বাতাসের তোড়ে ছুটে আসা জোয়ারের পানি।
তখনি আম্মা বিদ্যুতের বেগে বেঁকে থাকা ঘরের ভেতর ঢুকে আব্বাকে বললেন বাইরে হাটু পরিমাণ পানি, প্রবল স্রোতে। তাড়াতাড়ি বেড় হও। দুটো হারিকেন দুটি রুমে জ্বলছিল। ৪ বছরের ছোট বোনটিকে মা কোলে নিলেন, আব্বা আমাকে ডান হাতে এবং বড় ভাইকে বাম হাতে ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বাতাসের মধ্যে মাকেসহ ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাইরে তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি, দমকা হওয়া। মুহূর্তে আমরা ভিজে জবুথবু। গায়ে পড়তে লাগলো এক ছটাক বা তারও বেশি ওজনের বৃষ্টির ফোঁটা। মনে হচ্ছিল কেউ পাথরের টুকরো মারছিল গায়ে। তাও গেঞ্জি গায়ে থাকায় বৃষ্টির ফোটার চোট কম লাগছিল।
অথচ এ অনুভুতি প্রকাশ করার ইচ্ছে হচ্ছিল না। প্রবল স্রোতে পানি তখন অব্বা-আম্মার হাটুর ওপরে উঠে গেছে, আমার ও বড় ভাইয়ের কোমড় পানিতে ডুবে গেছে। আমরা ছোট ছোট তিন ভাই বোন কারো মুখে কোন কান্না নেই। আব্বা-আম্মার মুখেও কোন হা-হুতাশ নেই। শুধু শুনছিলাম আম্মাকে উদ্দেশ্য করে আব্বার নির্দেশ-এই দিকে এসো, এখানে দাঁড়াও, ওটা ধরো। তারা পানি ভেদ করে ঘর থেকে ২৫ গজ দক্ষিণ পশ্চিম কোনে বাগানের একটি বিশাল আম গাছের গোড়ায় আমাদের নিয়ে এলেন। ততক্ষণে পানির স্রোতে আব্বা-আম্মার কোমর ছুই ছুই।
তারা আমাদেরকে ঠেলে ওই বিশাল আম গাছে তুলে দিলেন মুহূর্তে। উঠোন থেকে প্রায় ৯ ফুট ওপরে আম গাছটির দুটি কাণ্ড। যেখান থেকে সামান্য ফাঁকা হয়ে ওপরে উঠে গেছে আরো দু’টি মোটা ডাল। আমি একটি ডাল বেয়ে আরো প্রায় ৮ ফুট ওপরে উঠে ওই কাণ্ডটি ভাগ হয়ে আরো দুটি হওয়া স্থানে দুটি পা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বসে গাছটিকে দু হাতে শক্ত করে ধরে আব্বা-আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বড় ভাই ততক্ষেণে ছোট বোনকে নিয়ে আম গাছটির প্রথম কাণ্ডের ওপর দাড়িয়ে আছে। বড় ভাইও আব্বা-আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমরা ঘর থেকে বের হয়ে বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে কিছুক্ষণ কাটানোর পর চারদিকে প্রায় সব দেখতে পাচ্ছিলাম। কারন সময়টা ছিল ১৬/১৭ রমজানের। রাত সাড়ে ১০টার দিকে আকাশে চাঁদ থাকায় প্রচণ্ড মেঘচ্ছন্ন হলেও বড় বড় বৃষ্টির ফোটা ও সাগরের ন্যায় প্রবল পানির স্রোত আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। আব্বা-আম্মা আমাদেরকে আম গাছে ঠেলে তুলে দিয়ে মুহূর্তও দাঁড়াননি। পানি ভেদ করে আবার চলে গেছেন ঘরের মধ্যে। ততক্ষণে ঘর ৪০ ডিগ্রি কোনে বেঁকে গেছে। ঘরের ভেতরে হাঁটু পানি। এ সময় ঘরের পাটাতন থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে ঘরের যত মালামাল মেঝেতে পড়ছিল আর ভেসে যাচ্ছিল।
আব্বা-আম্মা চাল ভরা কোলাগুলো যাতে ভেসে যেতে না পারে তাই পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছিলেন। খোয়াড়ের ছাগল তিনটি পানি দিয়ে টেনে নিয়ে বেকে যাওয়া ঘরের চালের ওপর তুলে দিলেন। ছোট ছাগলছানা দুটো কখন ভেসে গেছে খুঁজে পেলেন না। মায়ের স্বর্ণ ও রূপার গহনাগুলো একটা মাটির পাতিলে ভরে মুখটা গামছা দিয়ে বেঁধে ঘরের পাশে পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিলেন।
রমজান মাসে ৭টিন মুড়ি ভেঝে মা ঘরের মাচায় রেখেছিলেন। পানির স্রোতে সেগুলো মেঝেতে পড়ে পড়ে ভেসে যাচ্ছিল। তার একটির আংটায় খপ করে ধরে ফেলেছিলেন মা। এতো কিছু করতে করতে আব্বা ও আম্মার বুক সমান হয়ে গিয়েছিল পানি। তাই তারা আর রিস্ক না নিয়ে আম গাছটির দিকে চলে এলেন।
নতুন টিনের ঘর বানানোর জন্যে আব্বা একটি বিশাল তাল গাছ কেটে ২৫ ফুট লম্বা ৮ খানা মুল্যবান আড় বানিয়ে ছিলেন। সেগুলোকে কয়েক দফা তেলে ভিজিয়ে ওই বিশাল আম গাছের প্রথম কাণ্ড এবং অপর একটি আম গাছের কাণ্ডের মাঝে আড়াআড়ি মোটা রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। আমাদেরকে যে আম গাছটির ৯ ফুট ওপরের কাণ্ডে ঠেলে তুলে দেয়া হয়েছিল ওই আড়গুলোর এক মাথাছিল এই কাণ্ডে। এতে আমরা উঠতে পেড়েছিলাম সহজে। আব্বা-আম্মা ফিরে এসে তারাও আমাদের সঙ্গে গাছে উঠলেন। আমাদেরকে হাত দিয়ে ধরতে পারেন এমন পজিশনে তারা গাছের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি আর বড় ভাই গাছের প্রায় ১৭/১৮ ফুট ওপরে। ঘর থেকে বের হবার সময় মা দুটো শাল জাতীয় চাঁদর নিয়ে এসেছিলেন। ভেজা সেই চাঁদর গুলো দিয়ে আমাদের পিঠ ও মাথা পেচিয়ে দিলেন।
রাত সোয়া ৯ টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত দেখলাম সুনামীর স্রোতে পানি বৃদ্ধির দৃশ্য আর ভিজলাম মুশলধারার বৃষ্টিতে। রাত দেড়টার দিকে বাতাস ও বৃষ্টি থেমে গেলো। আব্বার হাতে ছিল ঘড়ি আর টর্চ লাইট। এ দুটো ছাড়লেন না আব্বা। যখন বৃষ্টি থেমে গেলো পানির স্রোতও কমে গেলো। আমাদের গ্রামটাকে মনে হচ্ছিল সাগর। শুধু কয়েকটি নারকেল ও খেজুর গাছ এবং বড় বড় কিছু গাছের মাথার ঝোপ দেখা যাচ্ছিল। এমনি একটি ঝোপের মাথায় আম গাছে বসে ও দাড়িয়ে আছে আমাদের ৫ সদস্যের পরিবার। হাস-মুরগি, গরু-ছাগল, জন্তু-জানোয়ার, কাথা-কম্বল, খাট-পালঙ্ক, আসবাবপত্র, গাছের ভাঙ্গা ডাল-পালা, সাপ-বেজী সবই পানিতে ভাসছিল তখন। এদের কিছু ছিল মৃত আর কিছু জীবিত।
আমার পায়ের নিচে পানিতে একটি গরু নাক ডেকে ডেকে ভাসছিল, আমগাছের দু একটা করে পাতা ছিড়ে খাচ্ছিল। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর গোঙানী ছাড়া এসময় প্রকৃতিটা এমন নিরব-নিস্তব্দ হয়ে রইল যেন সবার আক্কল গুরুম। কেউ ভাবতেও পারেনি যে এমনটা হবে। কোথাও যেন পিন পতনের শব্দ নেই। ভেসে যাওয়ার সময় আম্মা একটি মুড়ির টিন তুলে এনে ছিলেন। সেটির একটি আংটা ছিল। আমি আম গাছের একটি চিকন ডালের মাথা ভেঙ্গে সেটি টিনের আংটাটার মধ্যে ঢুকিয়ে লটকে রেখেছিলাম। অবশ্য মুড়ির টিনের গোল ঢাকনাটা ভেসে যাওয়ায় কিছু বৃষ্টির পানি এর মধ্যে ঢুকে মুড়িগুলো ভিজে গিয়েছিল। যখন পিন-পতন নিরবতা বিরাজ করছিল তখন ওই ভেজা মুড়ি খেয়ে নিয়েছিলাম সবাই।
আব্বা-আম্মা ওই মুড়ি খেয়েই রোজা রেখেছিলেন। ওই নিরবতায় কেটে গেলো প্রায় ১ ঘণ্টা। তখনো ১৭/১৮ ফুট ওপরে যেন বিশাল সাগরের মাঝে গাছ জড়িয়ে আছি আমরা-পানি আমাদের পা ছুঁয়ে আছে। ভাসমান ময়লার স্তুপ আমাদের পায়ের নীচে ভাসছে। আব্বা-আম্মার পা বুক সমান পানির নীচে আম গাছটির প্রথম কাণ্ডের ওপর। কারন গাছের ওপরের দিকে উঠে এলে হয়তো ভেঙে পড়বে গাছটি তাই তারা ওপরের দিকে উঠছেন না।
আমাদের বলছেন, শক্ত করে ধরে রাখতে। আব্বার বন্ধু চান শরীফ মাঝি বাড়ির সাত্তার মিয়া। আমাদের বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে। নিরব-নিস্তব্ধতার সুযোগে আব্বা দরাজ গলায় গাছের ডালে বসেই হাঁক ছাড়লেন সাত্তার মাঝি, ও সাত্তার মাঝি, আপনারা কোথায়? উত্তরে সাত্তার মাঝি জবাব দিলেন, মলান সা’ব (মাওলানা সাহেব) আমরা ভাল আছি, আপনারা?
আব্বা বললেন, আমরাও ভালো আছি। দু’ পক্ষের কুশল বিনিময় শেষ। এরপর ১০ মিনিট অতিবাহিত না হতেই শুরু হলো রূপকথার সেই গল্পের মতো সোঁ সোঁ শব্দ করে দৈত্য আসার বিকট আওয়াজ। উত্তর-পশ্চিম কোন থেকে আসছে সেই শব্দ। ইতোমধ্যে ওই দিকের আকাশ ঘোর কালো হয়ে গেছে। কনকনে শীতল বাতাসের ঝাপটা আর মুশলধারার বৃষ্টি নিয়ে কালপিনি হয়ে আসছে উল্টোঝড়।
এর কয়েক মিনিটের মধ্যে শুরু হলো নারকীয় তন্ডবে প্রলয়ংকরী ঝড়। উত্তর-পশ্চিম কোন থেকে পূর্ব-দক্ষিণমূখী উল্টো ঝড়। অন্ধকারে ঢেকে গেলো অমাবশ্যা রাতের চেয়েও কালো হয়ে। এতোই অন্ধকার হলো যে আব্বা-আম্মা ও বড়ভাই কাউকেই আর দেখা যাচ্ছিল না। সাথে মুশলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির একেক ফোটা যেন গায়ে ছোট ছোট পথরের ন্যায় এসে বিধছিল। ঝড়ের ঝাপটা আর পাহাড় সমান ঢেউয়ে আমাদের আম গাছের ডালগুলোসহ বাগনের সব গাছগুলো যেন একবার পানির মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল-আবার খাড়া হচ্ছিল। আমরা একবার পানির মধ্যে ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম- আবার পানির ওপরে উঠছিলাম। কারো যেন হুঁশ নেই ঝড়ের তাণ্ডবে-তখন আমাকে কেউ বলছেনা যেনো আম গাছের ডাল টাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরতে। কারণ সবাই ব্যস্ত নিজেকে গাছের সাথে জড়িয়ে রাখার চেষ্টায়।
আব্বা-আম্মাও হয়তো সে সময় দিশেহারা-না পারছেন আমাদের ধরে রাখতে, সহায়তা করতে, কারণ নিজেকে নিজে বাঁচাতে পারবেন কিনা সে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন তারাও। এমনি চললো প্রায় দেড় ঘণ্টা। হাজার হাজার নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু যারা আশ্রয় নিয়েছিল গাছে, টিনের ঘরে, ঘরের বা স্কুলের চালে সবাই উল্টো ঝড়ের তাণ্ডবে লাশ হয়ে ভেসে উঠলো, কেউ হাবুডুবু খেতে লাগলো। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, মানুষ, কুকুর-শেয়াল, সাপ-বেজি, খড়-কুটো, ঘর, ঘরের চালা, দোকান-পাট, কলসী-হাড়ি-পাতিল, ঘরের আসবাবপত্র, ভেঙে বা উপড়ে পড়া গাছ-পালা, বাড়ী-ঘরের ভাসমান আবর্জনা, তৎকালীন কাচা ল্যাট্রিনের প্রসাব-পায়খানা সব গোলক ধাধার মতো ঘূর্ণি বাতাসে ঘুরছিল একাকার হয়ে।
বাঁচাও বাচাঁও বলে কোথাও চিৎকার, কোথাও আটকে পড়া মানুষের গোঙ্গানী-যেন কেয়ামতের ময়দানের মতো চলছিল নি:শব্দ মাতম। কিন্তু বেশী ক্ষণ টিকলো না এ চিত্র। সুনামীর ন্যয় পাহাড় সমান ঢেউ আর স্রোতে সবকিছু মুহূর্তে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সাগরে। ঘটনাটা হলো এমন যেন সাগরে এলো জোয়ার, আবার ভাটার টানে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো সবি।
যখন ঝড় থামলো, সারা পৃথিবী মনে হলো নিরব নিস্তব্দ। কোথাও টু-শব্দটি নেই। তখন হয়তো ভোর পাঁচটা। আজ আর আযানের সুর ভেসে এলোনা কোন দিক থেকে। কাউকে নামাজ পড়তে বা উলুধ্বনি দিতেও শোনা গেলোনা কোন দিকে। নির্ঘুম এক কালরাত কেটে গেলো। পানিও কমে গেছে। আমরা আম গাছের সেই মগডাল থেকে একটু নিচে নেমে এলাম। আব্বা গায়ের গেঞ্জিটি খুলে চিপে ভালো করে পানি ফেলে দিল। আবার ভেজা গেঞ্জিটি গায়ে দিলাম, গায়েই সেটি শুকাতে থাকলো। গাছের যে কাণ্ডটিতে তাল গাছের আড়াগুলো লম্বালম্বিভাবে অন্য একটি আম গাছের সাথে যে ভাবে বাধা ছিল সে গুলো সেভাইে রইল। আমরা সেগুলোর ওপরে নেমে বসলাম। মুড়ির টিন নামিয়ে আনলাম, কয়েক মুঠো করে সবাই মুড়ি খেলাম। পানি খাওয়া আর হলো না। এমন কি পানির পিপাসাও লাগলো না। এমনি করতে করতে সকাল হলো।
তখন হয়তো সকাল সাড়ে ৬ টা। কি আশ্চর্য! কোথাও এক টুকরা মেঘ নেই। লাল থালার মতো পূর্বাকাশে সূর্য উঠলো। টকটকে রোদ বাড়িটা চিকচিক করে উঠলো। কারো ভিটায় ঘর নেই। উঠোনে প্রাপ্ত বয়স্কদের কোমর সমান পানি –তাও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। আমাদের ঘরের ভিটেটা খালি বোঝা যাচ্ছিল- কারণ ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও কয়েকটি মোটা মোটা খুটি এদিক সেদিক বেঁকে দাঁড়িয়েছিল। আমরা গাছে বসেই রইলাম। পুকুর, উঠোন, বাগান সাব জায়গায় শুধু ভেসে আসা আবর্জনা। এগুলো আটকা পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উঠোনে প্রায় ৫০-৬০টি ডাব ও ঝুনা নারকেল ভাসছিল। এক সময় দেখলাম দুটো বড় সাপ উঠোনের এ মাথা থেকে আরেক মাথায় সাতার কেটে যাচ্ছি। মা বললেন, আটকে পড়া ঝোপ ও জঙ্গলগুলোর মধ্যে সাপ থাকতে পারে-তাই আমাদের নামতে নিষেধ করলেন মা। তখন হয়তো সাড়ে সাতটা বাজে, পানি আরো কমে গেলো।
পাশের বাড়ির খোরশেদ (১৫) সাঁতার কেটে কেটে নারকেল কুড়োচ্ছিল। পাশের বাড়ির কাঞ্চনের বাপ বললেন, সবগুলো নিওনা, এগুলো আমাদের গাছের। খোরশেদ কিছু নারকেল নিয়ে চলে গেলো। ইতোমধ্যে আব্বা-আর আম্মা নেমে গেলেন উঠোনের হাটু পানিতে। পানি আরো কমে যাওয়ায় ঘরের ভিটা জেগে উঠেছে। আব্বা-আম্মা ৩০/৩৫ টির মতো নারকেল কুড়িয়ে ঘরের ভিটার ওপরে এনে জড়ো করলেন
আব্বা একটি বাঁশ নিলেন হাতে। বাড়ির ভেতরের বিভিন্ন আনাচে কানাচ থেকে ২৮টি শিশু, কিশোর, মহিলা ও পুরুষের লাশ বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে বাড়ির বাইরে ধান ক্ষেতে পাঠিয়ে দিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। লাশগুলো কোথায় নিয়ে গেছো। বলেছিল পানি থাকতে এগুলো দূরে ধান ক্ষেতে ঠেলে দিয়েছি। পানি শুকিয়ে গেলে এগুলো ধরে সরাতে ৪/৫ জন করে লোক লাগবে তাই। আব্বা বাড়ি থেকে লাশ সরানোর কাজ করলেও মা ঘরের ভিটার চার পাশে পানির মধ্যে চষে বেড়াতে লাগলেন আমাদের কোনো আসবাবপাত্র পাওয়া যায় কিনা তার খোঁজে।
বেলা ১১টা পর্যন্ত চলে মায়ের এ অভিযান। প্লেট-পিরিচ, থালা-বাটি পাতিল এগুলো তুলে তুলে এনে মা ভিটের ওপরে ধুয়ে জড়ে করতে থাকেন। এগুলো পাওয়া সম্ভব হয়েছিল, কারণ যখন ঘরের ভেতর পানি ঢুকেছিল তখন মা ইচ্ছে করেই এসব আসবাবপত্র পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ভেসে যেতে না পারে। বেলা ১১টায় আমাদেরকে ঘরের ভিটার ওপর তুলে নিলেন আব্বা-আম্মা। তারা দুজন কিছু না খেয়েই রোজা। আমাদেরও ক্ষুধা নেই। কারন কোথাও কোন খাবার নেই। কারো বাড়িতে আগুন নেই, চাল নেই, লবন নেই। নারকেল ভেঙ্গে খাওয়াবে – দা নেই। অবশেষে পাশের বাড়িতে একটি দা-এর সন্ধান মিললো। আব্বা সেটি এনে নারকেল ভেঙে আমাদের পানি খাওয়ালেন। ক্ষেতে শুরু করলাম কাঁচা নারকেল।
হঠাৎ মা পানির নিচ থেকে এক কলসি চাল আবিস্কার করলেন। তাও অর্ধেক পানি অর্ধেক চাল। চালগুলো ধুয়ে ভিটায় শুকাতে দিলেন। ভিজে ফুলে ওঠা কাঁচা চালও চিবিয়ে খেয়েছি কয়েক মুঠো। সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিটায় আব্বা-আম্মা একটা টংঘর বানাতে সক্ষম হলেন, আগুন, খাবার পানি, লবন, চাল-ডাল সংগ্রহ করতেও সক্ষম হলেন তারা। ভেসে আসা একটি লাউ তরকারী হিসেবে সঙ্গ হলো। রাতের খাবার দিয়ে শুরু হলো নতুন জীবন।
রেডিও-টিভি না থাকায় আবহাওয়ার খবর শোনা যায়নি। উপকুলের লাখ লাখ লোক জানতে পারেনি ৩ নম্বর বিপদ সংকেত ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতে রূপ নিয়েছে। বাতাসের ১৮৫ কিলোমিটার বেগ নিয়ে নিম্নচাপটি রূপ ধারণ করেছে প্রলয়ংকরী হ্যারিকেনে। লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে উপকূল। তাইতো শরু হয়েছে কান্নার রোল, কারণ প্রতি ঘরে ঘরে ৩/৪ জন করে স্বজন হারাতে হয়েছে সবাইকে। কারো ঘরের সকল সদস্য পানিতে ভেসে গেছে। আমাদের গ্রামে শুধু আমরাই ৫ সদস্যের পরিবার জীবিত আছি কাউকে না হারিয়ে। সারারাত বৃষ্টি-আর ঝড়ে লুটোপুটি খেয়ে। আম গাছটি উপড়ে গেলে হয়তো আমরাও ভেসে যেতাম স্রোতের তোড়ে। ঘরে বাতি দেয়ার কেউ থাকতো না আমার পিতার সংসারে। তবে সবই আল্লাহর ইচ্ছে, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’।
উল্লেখ্য, জলোচ্ছ্বাসটি ছিল মুলত: ভোলা, পটুয়াখালী ও নোয়াখালী এই অঞ্চল কেন্দ্রিক। তবে জলোচ্ছ্বাসের কেন্দ্র ও প্রভাবিত এলাকা মিলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২৫০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে এই মহাপ্রলয়। ১০ লাখ মানুষ, ২০ লাখেরও বেশি হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগলসহ বন্য প্রাণী ভেসে যায় এই দিন সাগরে। শুধু ভোলাতেই প্রাণ হারিয়েছে আড়াই লাখ নারী-পুরুষ-শিশু। চরফ্যাসনের ঘরে ঘরে বেঁচে ছিল মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ। আর সবাই ভেসে গেছে বঙ্গোপসাগরে।
কথিত আছে এ জলোচ্ছ্বাসের পর অনেক বাড়ির পুকুরে পাওয়া যায় ইলিশ মাছ। এ বন্যার পর মানুষ ইলিশ মাছ খাওয়া প্রায় ছয় মাস বন্ধ রাখে। কারণ মানুষের লাশ ছিল ইলিশের প্রধান খাদ্য। আর সে বছর ইলিশও ধরা পড়েছিল প্রচুর। জলোচ্ছ্বাসের পর সারা গ্রামে ছিল শুধু লাশ আর লাশ, গরু-ছাগল হাঁস মুরগীর মৃতদেহ। এগুলো মাঁটি বা মাঁটি চাপা দেয়ার কেউ ছিল না। এই মহাপ্রলয়ের ১০/১৫ দিন পর ১০/১২ জনের একটি টিম আসে এলাকায়। তাদের সাথে ছিল খন্তা-কোদাল আর ব্লিচিং পাউডার। সবাই মিলে ৫০০ গজের মধ্যে যে সব লাশ পেয়েছে সেগুলো এক জায়গায় জমা করে মাঁটি চাপা দিয়েছে। আর গবাদী পশুর মৃতদেহগুলো এক জায়গায় নিয়ে সমান্য মাটি ছিটিয়ে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে সাদা করে দিয়েছে।
আমাদের বাড়ি থেকে কেরামতগঞ্জ বাজারে যেতে একটি লাশ রাস্তর পাশের পানিতে ১৫ দিন ভেসেছে। কেউ খোঁজ নেয়নি। সৎকারের লোক মেলেনি। লাশটির উপরের অংশ রোদে পুড়ে লাল হয়ে গিয়েছিল। পাশ দিয়ে মানুষ নাক চেপে আসতো যেতো। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই দুর্যোগ মোকাবেলায় চাঙ্গা হতে সময় নিয়েছে ৪/৫ দিন। এই মহাপ্রলয়ের ৪ মাস পরে ’৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তাই এটি পৃথিবীর ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তর মানবিক বিপর্যয় হলেও সেভাবে প্রচার পায়নি। যথাযথভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন বা মূল্যায়ন করা হয়নি।
ইদ্রিস মাদ্রাজী : সাংবাদিক, সমাজকর্মী। এমএসএস-সমাজকর্ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়