কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের অনুষ্ঠানে, সওগাত অফিসে। সেখানে একটা সাহিত্যের আড্ডা হতো। এক পক্ষে একবার বা মাসে একবার, আমার ঠিক মনে নেই। সে আড্ডায় থাকতেন শহীদ কাদরী, হাসান হাফিজুর রহমান (উনি ছিলেন মধ্যমণি, অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন), খালেদ চৌধুরী (দার্শনিক টাইপের লোক ছিলেন। সমালোচনা করতেন সবাইকে, কাউকে রেহাই দিতেন না—অনেকের খারাপ লাগত সেসব সমালোচনা)।
একবারের আড্ডায় খালেদ চৌধুরী আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্প সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। সেখানে শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। সেটা ৫০ দশকের শেষের দিকে, অথবা ৬০ দশকের প্রথমভাগে—এখন আমার ঠিক মনে নেই ভাই। ঠিক মনে পড়ছে না এর আগে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিনা। তবে শামসুর রাহমানের বিয়ের ভোজে আমি উপস্থিত ছিলাম।
সওগাত অফিসের সাহিত্য আড্ডা শেষ হলে সবাই যে যার গন্তব্যে চলে যাচ্ছিল। আমি তখন শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীর সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম। তাঁদের সঙ্গে ভালো করে পরিচয় হলো। তখন মার্কসীয় দর্শনের একটা প্রভাব ছিল সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে। তাঁদের সঙ্গে আলাপে আমি বুঝলাম এঁরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী কবির দল। আমি এঁদের দিকে ঝুঁকে পড়লাম।
অনেক দিন আগের কথা। তখনকার ঢাকা এত আধুনিক হয়নি, তখনও রাস্তায় গ্যাসের বাতি জ্বলত। ভিস্তিওয়ালারা নবাবপুর রোড ভোরবেলা ধুয়ে দিত। এ সময় ভোরবেলা প্রায়ই আমি একা একা নবাবপুর রোড দিয়ে হেঁটে বেড়াতাম। সংবাদপত্রে চাকরি করতাম তো, রাতে অফিস ছিল। ভোরবেলা হাঁটার পর নাস্তা-টাস্তা খেয়ে গিয়ে ঘুমাতাম।
দৈনিক পাকিস্তান অফিসে (শামসুর রাহমানের কর্মস্থল) মাঝেমধ্যে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। আমি তখন ‘কাফেলা’ নামের একটা সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পত্রিকায় (নাজমুল হক ছিলেন মালিক) দিনে কাজ করতাম। রাতে কাজ করতাম ইত্তেফাকে। কাফেলার অফিস ছিল ইসলামপুরে। কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদনা করতেন কাফেলা। বেতনের ঝামেলার কারণে তিনি ছেড়ে দিলেন। তখন পত্রিকার কপি দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো আমাকে। এভাবে ‘কাফেলা’র সঙ্গে আমার ইনভলভেমন্টটা শুরু। শামসুর রাহমানরা পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের আড্ডায় যেতেন সওগাত অফিসে। তার পাশেই ছিল কাফেলা অফিস। আসতে-যেতে দেখা হয়ে যেত, আর আমিও তো যেতাম।
মাঝেমধ্যে তাঁর বাসায়ও যেতাম। পুরান ঢাকায় আশেক লেনে (ইউনিভার্সেল প্রেস) বাসা ছিল তাঁর। শামসুর রাহমান ছিলেন খুবই ভালো লোক। তিনি সোজা-সরল মানুষ ছিলেন। তবে তাঁকে ঘিরে থাকত রাজনৈতিক-মনস্ক একদল কবি, সাহিত্যিক এবং আমার মনে হয় তারা তাঁকে খুব প্ররোচনা দিতেন নানা বিষয়ে। শামসুর রাহমান এদের কথায় দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বাস করতেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্কই ছিল। এ সম্পর্কটা কখনও নষ্ট হয়নি। তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটা বজায় ছিল। মৃত্যুর এক মাস আগেও তিনি আমার বাসায় এসেছিলেন। অনেকক্ষণ ছিলেন। চা খেতে চাইলেন। আমার স্ত্রীকে বলে দিলেন কিভাবে চা’টা বানাতে হবে।
এক অসাধারণ কবি হিসেবে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি লিখেছেনও প্রচুর। যদিও পুনরাবৃত্তি দোষে অনেকেই তাঁকে দায়ী করেছেন; কিন্তু এমন স্বতঃস্ফূর্ত পয়ার রচনা করতে আর কেউ পারেননি।
শামসুর রাহমান ছিলেন মূলত একজন রোমান্টিক কবি। ছন্দসিদ্ধি, বিষয়বস্তুতে, শব্দে লাবণ্য সংযোজন এবং একইসঙ্গে অব্যাহত লেখার ক্ষমতা তাঁকে বিশিষ্ট করেছে। সব সময়ই দেখেছি, নগরমনস্কতা তাঁর কবিতায় উল্লেখযোগ্য একটি স্থান দখল করে আছে। তিনি ইচ্ছাও করতেন ওই ধরনের লেখার, যেখানে শহর প্রাধান্য পাবে। আমার সঙ্গে তাঁর মৌলিক পার্থক্যটা এখানে যে, আমি গ্রামকে সব সময় প্রাধান্য দিয়েছি এটা বলব না, আমি গ্রাম এবং শহর দু’জায়গাতেই জীবন কাটিয়েছি; গ্রাম ও শহর দু’জায়গার কথাই আমি বলতে চেয়েছি। তাঁর পয়ারে যে আশ্চর্যজনক সিদ্ধি, ভাষাকে নমনীয় করে পয়ারে তা লিখে ফেলার যে ক্ষমতা—তা আমাকে অভিভূত করত।
আমার এ মুগ্ধতার কথা তিনি জানতেন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছিল না। মানুষ বলত, তিনি বিশ্বাস করতেন। কোনো বৈরিতা ছিল না। শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার কোনো কাব্য-হিংসার সম্পর্ক ছিল না। তাঁর সঙ্গে আমার বয়সেরও তফাত্ খুব বেশি নয়। আমার কবিতা সম্পর্কে কখনও তিনি মুখ খোলেননি। শুধু আমার কেন, তাঁর সমসাময়িক বা তাঁর পরের কোনো কবি সম্পর্কেও তিনি কোনো কিছু লেখেননি। তাঁকে কোনো মন্তব্য করতেও দেখিনি। এটার কারণ মনে হয় তিনি সেটা সচেতনভাবেই চাইতেন না।
আমার এবং শামসুর রাহমানের নাম পাশাপাশি উচ্চারিত হয়। এই উচ্চারণ অনেকে করে থাকেন। এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য হলো, শামসুর রাহমানের পরে তাঁর সমসাময়িক অনেক কবির নাম উচ্চারিত হতো। আমার নাম আসত অন্তত ২০/২২ জনের পরে। কিন্তু সহসা দেখা গেল, শামসুর রাহমানের পরেই আমার নাম উচ্চারিত হচ্ছে। সেটা শুরু করেছেন শামসুর রাহমানের নিকটজনরাই। সাহিত্যে এটা ঘটে। আমি এসব ব্যাপারে কোনো অতিরিক্ত পুলকও বোধ করি না—ক্রুদ্ধও হই না। সব সময় ভেবেছি যে, আমি স্বতন্ত্র পথের যাত্রী। শামসুর রাহমানের পথের যাত্রী আমি নই। ফলে আমি অন্যরকম কবিতা লিখতে পেরেছি; আলাদা একটা কাব্যভাষা এবং কবি-পরিমণ্ডল গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছি। এটা আমার বক্তব্য নয়, এটা আমার কালের সাহিত্য বিচারকদেরই মন্তব্য।
আমার কথা হলো, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি—শামসুর রাহমানের গদ্য ভাষা সচ্ছল ছিল না। সম্ভবত এজন্য তিনি গদ্য খুব বেশি লেখেননি। কবিতায়ই তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল এবং প্রাণভরে তিনি কাব্যচর্চাই করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাঁর কবিতা পড়ে আমি কখনও অবসাদ বোধ করিনি। আমি ভবিষ্যদ্বক্তা নই। সুতরাং মহাকালের বিচারে তাঁর কবিতা কী মূল্যায়ন পাবে, তা বলতে পারি না। শামসুর রাহমানের শব্দ, ছন্দের গঠন প্রক্রিয়া এবং ভাষায় মাধুর্য তাঁকে অনেকদিন পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি হিসেবে বাঁচিয়ে রাখবে।
আমার সবচেয়ে দুঃখ যে, শামসুর রাহমান খুব অকালে চলে গেলেন। আমার আক্ষেপ যে, তাঁর বাঁচার সাধ ছিল—সেটা পূর্ণ করে যেতে পারেননি। আমাকে তিনি বলতেন তাঁর বাঁচার সাধ সম্পর্কে।
আমাদের সঙ্গে তরুণদের একটা গ্যাপ হয়ে গেছে। এই গ্যাপটা পূরণ করার মধ্যবর্তী কেউ ছিল না। কথা হলো যে, আধুনিক সাহিত্য বলতে কবিতাকে বোঝায় না অন্যান্য দেশে। বাংলাদেশে উল্টো ঘটনা ঘটল। এদেশের প্রধান তিনজন লেখক তিনজনই কবি ছিলেন। এঁরা হলেন শামসুর রাহমান, আমি ও শহীদ কাদরী। এই যে কবিতাকে আমরা প্রাধান্য দিলাম, এ ব্যাপারে আমাদের যুক্তি ছিল—রাজনীতি ছিল। সবচেয়ে বড় কথা—বিষয়বস্তুও ছিল। আমরা আন্দোলন করে কবিতাকে এই বাস্তবতার মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। অথচ কাজটা করার কথা ছিল কথাশিল্পীদের।
# আধুনিক বাংলা কবিতার ‘বরপুত্র’ শামসুর রাহমানের দশম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ উপলক্ষে লেখাটি প্রকাশিত