শহীদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল জার্মানির কোলনে। আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা বিভাগের জনাবা নাজমুন্নেছা। সে সময় শহীদ ওদের ছেলে আদনানকে নিয়ে সেখানে থাকতেন। তার আগে শহীদ কাদরীর কবিতা, বলাবাহুল্য পড়েছি, খুব বেশি না। পড়েছি কি প্রধানত, আমার অত দূর নাগাল ছিল না।
আমাদের বন্ধু আবদুল্লাহ আল ফারুক ও সহকর্মী শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত ওদের কাছে বই ছিল শহীদের। সেসব পড়েছিলাম। তারপরে উনি এলেন এবং আসার সময় থেকেই প্রথম দিকে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এর একটা কারণ ছিল, আমার হাতে সময়ও ছিল। আমি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ছিলাম। আমরা কাছাকাছিও থাকতাম।
এটা ১৯৭৬-৭৭ হবে। আমার তখন ৩০ বছরও বয়স হয়নি। শহীদ আমার চেয়ে বয়সে কিঞ্চিৎ বড়, চিরকাল আপনি আপনিই করে গেছি। কিন্তু অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই সময়টাতে আরকি।
উনি ভীষণ রসিক লোক। সারাক্ষণই কোনো না কোনো রসিকতা করতেন, সেটা বাংলাদেশের অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই বলা যায়, রসিক। এবং অসম্ভব লেখাপড়ার রেঞ্জ। মাঝেমাঝে হাঁটতে হাঁটতে, আমরা যেখানে থাকতাম, সেটা আসলে ছিল কোলনের প্রাণকেন্দ্র। ওখানে হাঁটতে হাঁটতে আমরা কফির দোকানে বসতাম। বইয়ের দোকানে ঢুকতাম।
একটি ঘটনা, স্যরি দুঃখের মধ্যেও হাসি পাচ্ছে, উপায় নেই (একটি ঘটনার কথা মনে করে হেসে ফেলেন)। একটা বই ছিল কার যেন লেখা, ‘এসেন্ট অব ম্যান’, বইটা দেখে আমার কেন জানি লোভ হলো। শহীদ বলল, বইটা খুব ভাল, বুঝলেন সুমন। বইটা খারাপ না ভাল। তারপরে গল্প করতে করতে আমরা চলে গিয়েছি।
আমি বিকেল বেলায় এসে বইটা কিনে নিয়েছি, বুঝলেন? এটা আমি শহীদকে বলিনি। পরের দিন শহীদ বলল, চলেনতো বইয়ের দোকানটায় আবার যাই। হাঁটতে হাঁটতে গিয়েছি। ওখানে বইটি নেই। আমি তখনো ওকে বলছি না যে, বইটা আমি কিনেছি। উনি বললেন, বইটা কোথায় গেল? বইটা কোথায় গেল? আমি বললাম, আমি কী করে জানব?
এরপর চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে, ‘বইটা না, এবার আমি খুঁজছি, বইটা যে কিনেছে তাকে।’ এই হচ্ছেন শহীদ কাদরী, বুঝলেন? এই দুঃখের সময়েও না হেসে উপায় নেই।
আমি কলকাতায় একজনকেও চিনি না, যিনি এই রকম রসিকতা করতে পারেন। উনি আন্দাজ করতে পেরেছেন আমি কিনেছি, বুঝতে পারছেন।
তারপর আমি বলে দিলাম হাসতে হাসতে, ‘আমি কিনেছি’। ও বলেছে, ‘আমি জানি না ভেবেছেন? আপনি বিকেলবেলা বা কখন এসে কিনে নিয়েছেন।’
সে খুব সেনসিটিভ একজন মানুষ, ভীষণ সংবেদনশীল, রসিক, শিক্ষিত। আমি ওই রকম শিক্ষিত একজন আধুনিক বাঙালি তার আগে খুব কম দেখেছি। এটা আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে যা-ই মনে করুন।
আমি পশ্চিমবঙ্গের, তখন আমার যৌবন মনে রাখতে হবে, কাজেই পশ্চিমবঙ্গে যে আমি সবাইকে চিনতাম তা না, কিন্তু এই রকম একজন শিক্ষিত আপাদমস্তক শিক্ষিত আধুনিক, সম্পূর্ণ উদার অসাম্প্রদায়িক মানুষ আমি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে দেখিনি।
কিন্তু মনে রাখতে হবে তখন আমার যৌবন। পরবর্তীকালেও আমি পশ্চিমবঙ্গে দেখিনি, শহীদের মতো আপাদমস্তক শিক্ষিত, আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি আমি পশ্চিমবঙ্গে…… না, দেখছি বলে মনে পড়ছে না। বলাবাহুল্য, আমি পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরুদের কথা বলছি।
উনি নিজের লেখা নিয়ে খুব কম কথা বলতেন। কিন্তু আবার বলতেনও। আমি মাঝে মাঝে বলতাম, আপনি কবিতা লেখেন কখন? উনি বলতেন, নাতো আমি কবিতা লিখি না তো! ওটা ইয়ার্কি মারি অনেক সময়। আমি বলি, মানে? ‘অনেক সময় আমি, ইয়ে মানে, হাসপাতাল বা কোনো জায়গায় গিয়ে কয়েকদিন থাকি।’
আমি বলি, ‘বাজে কথা বলেন না তো’। উনি বললেন যে, আমি যা লিখেছি, সেটা টা..না, একটানা লেখা।তিনি খুব মজার মজার গল্প করতেন। যেমন একটা গল্প, বলি সেটা। শহীদের একটা অদ্ভূত স্বভাব ছিল, সেটা বন্ধুরা জানে না আমি জানি। আমি যখন বোস্টনে শহীদের কাছে গেলাম। বললেন, সুমন কবিতা-টবিতার মধ্যে আমি কিন্তু আর নাই। আমি বললাম, মানে? ‘আমি কবিতা পড়িও না।’ হঠাৎ বললেন, হাতুড়ির নিচে কবিতা। এই রকম কবিতা যদি লিখতে পারতাম, তাহলে লিখতাম। কবিতা আমি পড়িও না।
খানিক সময় পরে আমি বাথরুমে গিয়েছি, বুঝলেন? শহীদের বাথরুমে। বাথরুমে গিয়ে দেখি, বাথরুমের সিটস্ট্যান্ডের নিচে সাত-আটটি কবিতার বই। ওইখানে কবিতার বই!
আমি বললাম যে, ইয়ার্কি মারার জায়গা পান না, আপনি কবিতা পড়েন না, সব বই ওখানে রেখেছেন কেন?
কবে নাকি একবার হয়েছিল, ঢাকার বাড়িতে বোধ হয় আল মাহমুদ হবেন, আল মাহমুদ বন্ধু তো.. আল মাহমুদকে বুঝানো হয়েছে শহীদ উনার কবিতা মুখস্থ বলতে পারেন। কিন্তু উনি বিশ্বাস করছেন না। বাথরুমে আল মাহমুদের কবিতার বই আগে থেকে রেখে দিয়েছে, বুঝতে পেরেছেন? বাথরুমে ঢুকে শহীদ একের পর এক কবিতা বলে যাচ্ছে সোনালি কাবিন-টাবিন। আল মাহমুদতো পায়চারি করছেন অস্থির হয়ে, ‘দোস্ত, এই তুই কি দেখালি? আমিতো জীবনে ভাবতেও পারিনি। এভাবে তুই আমার কবিতা পড়িস।’ ওখানে আরও দুইজন ছিলেন, যাদের একজনের ছাপাখানা ছিল। ওদের আড্ডার সব বন্ধুরা সেখানে যেতেন। আল মাহমুদ, শহীদ, মহাদেব সাহা সবাই আড্ডা মারতেন।
তারপর বেরিয়ে পড়লো যে, তিনি বাথরুমে ঢুকে আল মাহমুদের কবিতার বই থেকে পাঠ করছিলেন।
দেশ ছাড়ার প্রসঙ্গ
দেখুন। সঠিকভাবে কিছু উনি বলেননি। উনি আমাকে… যে কথাটি আমি বলব, সেটা কি আমার বলা ঠিক হবে? আমি ভারতের নাগরিক, বাংলাদেশ আমার বন্ধু রাষ্ট্র।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু উনি নিতে পারেননি। এটা উনি আমায় বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, আপনার মতো লোক যদি দেশে না থাকেন, তাহলে দেশের কী হবে? উনি আমায় বলেছিলেন, সুমন আপনি কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে চিনতেন না ব্যক্তিগত জীবনে। আপনি জানেন না।
বঙ্গবন্ধুকে ওইভাবে হত্যা করা আমি নিতে পারিনি, সুমন; আমি ফিরব না।
এটা উনি খুব সরাসরি বলেছেন।
উনি কিন্তু আমার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
উনি কী রকম জানেন, কলকাতার অভাবটা উনি কোনো দিন ভুলতে পারেননি। কলকাতা থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেক দিন পর্যন্ত ওর আম্মা, বড় ভাই আর ওকে স্থানীয় হিন্দুরা রক্ষা করেছিল অনেকদিন, অনেকদিন। ওরা বলেছে, আপনারা যাবেন না, আপনাদের যেতে হবে না। পরে নেতৃস্থানীয় হিন্দুরা এসে বলেন, আমরা আর আপনাদের রক্ষা করতে পারব না, কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আপনারা চলেই যান, আপনাদের আর রক্ষা করতে পারছি না। খুব কষ্ট নিয়ে উনারা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যেভাবে ওখান থেকে অনেক হিন্দু চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল।
যেমন ধরুন, আদনান আইসক্রিম খেতে চাইছে কোলনে, শহীদ বলছে আরে কি এখানে কি আইসক্রিম খাবি। আমি তোকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে আইসক্রিম খাওয়াব। আইসক্রিম মানে কলকাতা। শহীদ সমানে মিস করেছেন কলকাতা, তেমনি ঢাকা, বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকায় শহীদের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। এবং শহীদ তখনো প্রায় হাফপ্যান্ট পরা ছেলে। বুদ্ধদেব বসু জানতেন না, শহীদের বয়স এতো কম। আমার সামনে বসে বসে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা এভাবে একে একে বলে যাচ্ছেন, আমি কলকাতার কাউকে এরকম দেখিনি।
এটা কিন্তু উনি তার বহু বছর পর ’৭৬-৭৭ সালে জার্মানিতে একসাথে থাকা, আড্ডা-গল্প, সময় কাটানো, তারপর ১৯৮৫-তে আমেরিকা। তারপরেও সে কিন্তু একই থেকে গেছে। তফাৎটা শুধু এই, জার্মানিতে যখন ছিলেন, তখন রান্না করতেন না, আমেরিকায় বোস্টনের বাসায় যখন গেলাম তখন উনি ভাল করে মাংস-ভাত রেঁধে খাওয়ালেন। এই তফাৎটা হয়ে গেছে। কিন্তু এইছাড়া ভেতরে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি।
ওর কবিতাপ্রীতি, মানে সারা পৃথিবীতে কোথায় কী কবিতা বেরিয়েছে। আরেকটা কথা, আমি কখনো ভুলব না, আমি এখানকার বন্ধুদেরকেও বলেছি। শুনুন সুমন, যখন পাকিস্তানের হানাদাররা আসে, তখন কিন্তু আমরা সবাই পালিয়ে গিয়েছি, আমরা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। আমি আমার কবিতার বইগুলো মাটিতে পুঁতে দিয়েছি। পাইলেতো মারবে। ট্যাংক আসছে, বুঝলেন সুমন, ট্যাংকটা চলে যাচ্ছে সেই মাটির ওপর দিয়ে, যেখানে আমার কবিতার বই পোঁতা। আমার কবিতার বইগুলোকে চাপা দিয়ে যাচ্ছে, আমি সমানে ভাবছি, এবার একবার বিস্ফোরণটা হোক। এবার মাইনের মতো ফাট। ফাটলো না। একবারের জন্য বিস্ফোরণ ঘটাতে পারলাম না। তাহলে কিসের কবিতা? তাহলে আর কিসের কবিতা?