শিউল মনজুর
সবার প্রিয় কবি, কবিদের কবি শহীদ কাদরী ৭৪ বছর বয়সে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের নর্থশোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রবিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শহীদ কাদরী শুধুমাত্র বাংলাদেশের কবি নন। তিনি বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষাবাসীর কবি। পঞ্চাশ দশকের এ কবির মাত্র চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এই চারটি বইয়ের অর্ন্তভূক্ত কবিতা দিয়েই তিনি কাব্য সাহিত্যে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন।
বইগুলো হচ্ছে উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোন ক্রন্দন নেই (১৯৭৮) এবং আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯)।
তাঁর কবিতার বিষয়ে উঠে এসেছে রাজনৈতিক সচেতনতা, নাগরিক জীবনের সুখ দুঃখ এবং বিশ্বায়নের নানা বিষয়। সেই সাথে তাঁর কাব্যিক ভাষা ছিল গতিময় এবং সহজ সরল। যে কারণে পাঠক হৃদয়ে তাঁর কবিতার ম্যাসেজ পৌঁছে যেতো সহজেই। সর্বোপরি ম্যাসেজগুলো ছিল অত্যন্ত ভারী ও সর্বজনীন। এক কথায় তাৎপর্যময়।
বলা যায়, তাঁর কবিতাগুলো সহজেই হারিয়ে যাবে না অথবা পুরনো হয়ে যাবে না, তরুণ হৃদয়েই পঠিত হবে, অণুরনিত হবে আগামী কয়েক শতাব্দী।
তাঁর সর্বশেষ কবিতার বই, আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও ঢাকার অবসর থেকে প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে এবং এ বইটির অসম্ভব সুন্দর বা মনকাড়া প্রচ্ছদ করেছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। নীরাকে উৎসর্গ করা এ বইটিতে কবিতা অর্ন্তভুক্ত হয়েছে ৩৬টি। কিন্তু ৩৬টি কবিতাই অসাধারণ। বারবার পাঠযোগ্য। হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মনে হয় যেনো তাঁর কবিতা শুধু মাত্র সমকালকে কেন্দ্র করেই নয় একালকে অতিক্রম করে আগামি শতাব্দীর দিকে ধাবমান।
অন্যভাবে বলা যায়, তাঁর কবিতা চিরকালের আধুনিক।
এখানে আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও বইটির কয়েকটি কবিতার চুম্বক অংশ উপস্থাপন করা হলো;
এক.
মনজুর এলাহী আবার বললেন; বন্দুকের নলই
শক্তির উৎস। রক্তপাত ছাড়া শ্রেণীসাম্য প্রতিষ্ঠা
অসম্ভব, অনায়াসে কেউ শ্রেণীস্বার্থ ছেড়ে দেয় না
আমি জানালা থেকে দেখলাম
মনজুর এলাহীর গোটা বাগান
জোনাকীরা দখল করে নিয়েছে-
বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে।
(কবিতার শিরোনাম : বিপ্লব, পৃষ্টা-২১)
দুই.
এই গ্রহের মহাপুরুষেরা কে কী বলেছেন
আপনারা সবাই জানেন। এখানে বক্তৃতা আমার উদ্দেশ্য
নয়। আমি এক নগণ্য মানুষ, আমি
শুধু বলি: জলে পড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন
(কবিতার শিরোনাম : আপনারা জানেন, পৃষ্টা-১৮)
তিন.
হে নবীনা, এই ম্যানহাটানে বাতাসের ঝাপটায়
তোমার হঠাৎ খুলে যাওয়া উদ্দাম চুল
আমার বুকের পরে আছড়ে পড়লো
চিরকালের বাংলার বৈশাখের সত্বার মতন।
তোমার জবার মতো চোখে রাঙা শ্রাবণের জল
পালতোলা নৌকার মতন বাঁকাচোরা ঢেউয়ে ঢেউয়ে কম্পমান
তোমার বিপদগ্রস্থ স্তন।
আমি ভাবতে পারি নি কোনোদিন এতো অসাধারণ আগুন
প্রলয় এবং ধ্বংস রয়েছে তোমার চুম্বনগুলিতে।
(কবিতার শিরোনাম: আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও, পৃষ্টা-১৭)
চার.
আমাদের অপব্যয়িত সোনালি যৌবন নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো
বলো আজ! গণতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্যের ওপর আস্থা নেই আর।
এবং খুচরো পয়সার মতো পথে-বিপথে খরচ হয়ে গেছে
সমকালীন স্বপ্নগুলো আমার।
তাই বলি, বারবার বলি; না যেন ‘পড়ে আমার রক্ত পদচ্ছাপ
তোমাদের স্বতন্ত্র শতকে।
(কবিতার শিরোনামঃ স্বতন্ত্র শতকের দিকে, পৃষ্টা-১৩)
মূলত দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, প্রবাসের একাকীত্ব, আধুনিকতা আর জীবনের অভিজ্ঞতায়পুষ্ট এই বইয়ের রচিত কবিতাগুলো কবিতা পাঠকের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। জয় করে নিয়েছেন সকল কবিদের।
কেননা প্রতিটি কবিতায় রয়েছে গল্প, রয়েছে যুক্তি, রয়েছে অসাধারণ উপমা, রয়েছে নান্দনিক শব্দ সমাহার। ভালো না লেগে উপায় নেই। অথচ এই মহৎ হৃদয়ের কবিকে যৌবনের প্রারম্ভিক কাল থেকে ভবঘুরের মতো বা যাযাবরের মতই এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি দিতে হয়েছে। সর্বশেষ ঠিকানা হয়েছিল, আমেরিকার নিউ ইয়র্কে।
কবিকে বাঁচিয়ে রাখে তার সৃষ্টি, তার কবিতা। এই কবিকেও বাঁচিয়ে রাখবে, তাঁর গুচ্ছ গুচ্ছ অনন্য সৃষ্টিময় কবিতা। কবি শহীদ কাদরীর প্রতি রইল দীর্ঘ শ্রদ্ধা, দীর্ঘ ভালোবাসা।
শিউল মনজুর [] কবি ও কথাসাহিত্যিক।