মুসলিম উম্মাহর মিলন মেলা

ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান  []

হজ আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ ইচ্ছাপোষণ করা। ইসলামের পরিভাষায়, আরবি জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত শরিয়ত নির্ধারিত কাজ সম্পন্ন করাকে বোঝায়। ইসলামের মূল স্তম্ভগুলোর পঞ্চমটি হলো হজ। ইমান, নামাজ, জাকাত ও রোজার পরই হজের স্থান। হজ ইসলামের মূল স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত হলেও সব মুসলমানের ওপর তা ফরজ বা অবধারিত নয়। কেবল আর্থিকভাবে সামর্থ্যবানদের ওপরই হজ ফরজ, তাও জীবনে একবার। অতিরিক্ত আদায় করলে তা নফল ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে।

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন- আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন (সূরা আল-ইমরান :৯৭)।

কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ আদায় করেন হজরত আদম (আ.)। তারপর হজরত নূহ (আ.)সহ ইসলামের অন্যান্য নবী ও রাসূল এ দায়িত্ব পালন করেন। এর পর হজরত ইব্রাহিম (আ.) থেকে হজ ফরজ বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করে স্র্রষ্টা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে সব মানুষকে হজ করার আহ্বান করেন। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) এ আদেশের পর আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে আঙুল রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন :লোক সব, তোমাদের পালনকর্তা নিজ গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো। আল্লাহতায়ালা তার এ আদেশ বিশ্বের সবখানে পৌঁছিয়ে দেন।

হজের নানা বিধিবিধান হজরত ইব্রাহিমের (আ.) জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত স্মৃতিচারণ।

ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনান্তে জানা যায়, হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তার স্ত্রী হাজেরাকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। সেখানে, বর্তমান কাবা শরীফের অদূরে বিবি হাজেরা নবজাত শিশু ইসমাইলকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলেন। সাহায্যের জন্য কাউকে না পেয়ে তিনি পানির খোঁজে সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। এ ঘটনা স্মরণ করে হজ আদায়কারীরা এখনও তা করে থাকেন। আল্লাহতায়ালা বেহেশত থেকে হজরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়াকে দুনিয়াতে পাঠানোর পর তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

পরবর্তীকালে উভয়ে আরাফার ময়দানে এসে মিলিত হয়ে একে অপরকে চিনতে পারেন। এ ঘটনার স্মৃতিচারণে হজের অংশ হিসেবে মুসলিমরা আরাফার ময়দানে উপস্থিত হয়ে স্রষ্টার কাছে কান্নাকাটি করে ইবাদতে মগ্ন হন।

দৈহিক ও আর্থিক সমন্বয়ের ইবাদত হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হওয়ার অর্থ হলো, আল্লাহর রাসূল (সা.) ইসলামকে পাঁচ স্তম্ভবিশিষ্ট একটি তাঁবুর সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের ওপর; যার পঞ্চমটি হলো হজ। সুতরাং সামর্থ্যবান মুসলিম হজ আদায় না করলে তার অবস্থা মুসলমান হিসেবে ভাঙা ঘরের মতো অসম্পূর্ণ হবে।

সামর্থ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হজ আদায় করা উচিত। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছা করে, সে যেন তা তাড়াতাড়ি আদায় করে নেয়। কারণ যে কোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে (মুসনাদ আহমদ-১৮৩৩)। অন্য এক হাদিসে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন- ফরজ হজ আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারও জানা নেই- তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে (মুসনাদ আহমদ-২৮৬৭)।

হজ আল্লাহতায়ালার ফরজ বিধান হওয়াই তার গুরুত্ব ও তাৎপর্যের পরিচায়ক। এর ফজিলতও অপরিসীম। হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহকে (সা.) জিজ্ঞেস করা হলো, শ্রেষ্ঠ আমল কোনটি? তিনি বললেন- আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ইমান আনা। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কোন আমল? তিনি বললেন- আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করা। আবার জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কোন আমল? তিনি বললেন- মাবরুর হজ (বুখারী-২৬, মুসলিম-৮৩)।

মাবরুর হজ হলো- ১. তা হালাল উপার্জন থেকে হতে হবে; ২. গুনাহ, অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে; ৩. ঝগড়া-ফ্যাসাদ থেকে মুক্ত থাকতে হবে; ৪. হজের বিধানগুলো আল্লাহর রাসূলের পদ্ধতি অনুযায়ী হতে হবে; ৫. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও রিয়ামুক্ত হতে হবে; ৬. হজের পরে সব ধরনের পাপকার্য থেকে বিরত থাকতে হবে।

মাবরুর হজের মর্যাদা সম্বন্ধে আল্লাহর রাসূল (সা.) অন্য এক হাদিসে বলেন- এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত সময়ের জন্য কাফ্ফারাস্বরূপ। আর মাবরুর হজের বিনিময় বেহেশত ব্যতীত আর কিছু নয় (বুখারী-১৬৮৩, মুসলিম-১৪৪৯)। হজ আদায় করার মাধ্যমে পেছনের সব গুনাহ মুছে যায় ও হজ আদায়কারী নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।

আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশে হজ আদায় করল এবং তাতে কোনো রূপ অশ্লীল কথা ও কাজ করল না, সে ব্যক্তি হজ থেকে সেদিনের মতো নিষ্পাপ ও বেগুনাহ অবস্থায় ফিরে আসবে, যেদিন তার মাতা তাকে (নিষ্পাপ অবস্থায়) প্রসব করেছেন (বুখারী-১৪৪৯, মুসলিম-১৩৫০)।

হজের মাধ্যমে গুনাহগুলো দূরীভূত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর রাসূল (সা.) একটি উপমা দিয়ে এভাবে বুঝিয়েছেন :তিনি বলেন- তোমরা হজ ও ওমরাহ একসঙ্গে করো। কেননা, তা দরিদ্রতা ও গুনাহকে বিদূরিত করে, যেভাবে হাপর লৌহ এবং স্বর্ণ-রৌপ্যের ময়লা দূর করে। মাবরুর হজের প্রতিদান বেহেশত ব্যতীত কিছুই নয় (মুসনাদ আহমদ-১৬৭)।

হজ করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থবিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ আদায় করে না, তার কঠিন পরিণতির কথা হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, যে ব্যক্তির সামর্থ্য আছে অথচ হজ করে না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করল কি খ্রিস্টান হয়ে, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই (ইবনে কাছির- ১/৫৭৮)। হজ আদায় না করে সম্পদ অন্যত্র ব্যয় করা কিংবা বৈরাগী ও সন্ন্যাসী হওয়ার চেষ্টা করা ইসলাম সমর্থন করে না। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, হজের ক্ষেত্রে কোনো বৈরাগ্য নেই (মুসনাদ আহমদ-৩১১৪)।

হজে বিশ্ব মুসলিমদের মিলন মেলার সঙ্গে সঙ্গে এর মাঝে ইহকালীন ও পরকালীন অনেক কল্যাণও নিহিত- মহান আল্লাহতায়ালা হজরত ইব্রাহিমকে (আ.) কাবাঘর সংক্রান্ত একগুচ্ছ আদেশ দিয়েছিলেন। তার একটি হলো- মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা প্রচার করো, তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে, যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু জবেহ করার সময় তারই নাম স্মরণ করে। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার করো এবং দুস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও (সূরা হজ :২৭,২৮)।

হজে পরকালীন কল্যাণের মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, গুনাহ থেকে মুক্তিলাভ, সেখানকার বিশেষ বিশেষ স্থানে, ইবাদতের মাধ্যমে বহু গুণ সওয়াব হাসিল করা যেমন মসজিদে হেরেমে এক রাকাত নামাজের সওয়াব এক লাখ রাকাতের সমান হওয়া। এ ছাড়া তাওয়াফ ও সাঈ সেখান ছাড়া অন্য কোথাও কল্পনা করা যায় না। এর সঙ্গে সেখানে সারাবিশ্বের মুসলমানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, তাদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়া, ভাব আদান-প্রদান, বিশ্বের প্রথম শ্রেণির ইসলামী স্কলারদের সঙ্গ ও তাদের মূল্যবান উপদেশ ও নসিহত থেকে উপকৃত হওয়া, শরয়ী বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করা যায়। ইহকালীন কল্যাণের মধ্যে রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, দুনিয়ার সব রকম আধুনিক যন্ত্র ও মেশিনারিজের উৎপাদিত পণ্য ও সব ধরনের ফল একই স্থানে পাওয়া। সর্বোপরি বিশ্বের সব মুসলমান ভাই ভাই হিসেবে এক কাতারে শামিল হয়ে, আরব-অনারব, কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গের ভেদাভেদ ভুলে সবাই সমস্বরে আল্লাহর দরবারে হাজির কলরবে সাম্যের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।

হজ আদায় করে ফিরে এলে যেরূপ নানাবিধ ফজিলত অর্জিত হয়, হজ পালনকালে মৃত্যুবরণ করলেও তার ফজিলত অনেক। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন- এক ব্যক্তি আরাফার ময়দানে রাসূলুল্লাহর (সা.) সঙ্গে ওয়াকুফরত ছিলেন। হঠাৎ তিনি বাহন থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তাকে বরই পাতা সিদ্ধ করা পানি দিয়ে গোসল দাও। তার দুই কাপড় দিয়ে তাকে কাফন পরাও। তাকে সুগন্ধি লাগিও না এবং তার মাথাও আবৃত করো না। কারণ তাকে কিয়ামত দিবসে তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠানো হবে (বুখারী-১২৬৭)।

হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন- যে ব্যক্তি হজের উদ্দেশ্যে বের হলো, অতঃপর মৃত্যুবরণ করল, কিয়ামত পর্যন্ত তার হজের সওয়াব লেখা হবে (তবারানি-৬৩৫৭)।

 

ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান    অধ্যাপক, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts