আতিকুর রহমান নগরী [] ঈদুল আযহা ও ক্বোরবানি এ দুটি ব্যাপার আল্লাহ প্রদত্ত বান্দার জন্য এক স্পেশাল নেয়ামত। আর তা জিলহজ মাসেই পালন করা হয়।
হাদিসের আলোকে জিলহজ মাসের ফযিলতঃ
১. হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন, “ইবাদত-বন্দেগির জন্য যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশদিন ব্যতিত আল্লাহর নিকট উত্তম দিন আর নেই”।
২. হযরত যাবের (রা.) হতে বর্ণিত নবিয়ে করিম (সা.) ইরশাদ করেন, “ইবাদতের জন্য আল্লাহর নিকট যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশদিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর নেই”।
৩. অন্য এক হাদিসে আছে রাসুলে মক্ববুল (সা.) বলেন, “আরাফার দিনের রোযা দুইশত বছর রোযা রাখার সমতুল্য আর আশুরার দিনের রোযা এক বছর রোযা রাখার সমতুল্য”।
৪. হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত- আল্লাহপাক দিন সমূহের মধ্যে চারটি, মাসসমূহের মধ্যে চারটি, নারিদের মধ্যে চারজন, সর্বপ্রথমে যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের মধ্যে চারজন এবং স্বয়ং জান্নাত যেসকল নেক বান্দাদের প্রত্যাশি তাদের মধ্যে চারজনকে নির্বাচন করেছেন তাদেরকে সবার থেকে ভিন্ন মর্যাদার অধিকারি করেছেন।
মর্যাদাপ্রাপ্ত দিনগুলোঃ
(১) জুমআরদিন (২) আরাফার দিন (৩) ঈদুল ফিতরের দিন ও (৪) ঈদুল আযহার দিন।
মর্যাদাপ্রাপ্ত মাসসমূহঃ (১) মুহাররম (২) রজব (৩) যিলকদ ও (৪) যিলহজ্ব মাস।
ঈদ ও ঈদের খুশিঃ
‘ঈদ’ শব্দটি ‘আল-আউদু’ ক্রিয়ামূল থেকে নির্গত। যার অর্থ ফিরে আসা। আর যেহেতু বছরে দুবার আসে তাই তাকে ঈদ বলে। ঈদ মানে হাসি-খুশি, আনন্দ ইত্যাদি। তবে এ আনন্দ যেন না হয় শরিয়ত বিরোধি।
ঈদের আনন্দে যেন মিশ্রিত না হয় বিজাতিয় সংস্কৃতি। এ আনন্দে বেহায়াপনা বা অশ্লিল চিত্ত্ববিনোদনের কোন সুযোগ নেই। মহামানব মহানবি (সা.) যেভাবে ঈদ উদযাপন করেছেন আমাদেরকেও ঠিক সেভাবে করতে হবে। কেননা এতেই রয়েছে ইহ ও পরকালিন শান্তি।
ঈদের দিনের সুন্নত সমূহঃ
(১) গোসল করা (২) সুগন্ধি ব্যবহার করা (৩) ঈদের নামায না পড়া পর্যন্ত আহারকার্যকে পিছিয়ে রাখা। (৪) তাকবির বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া। (৫) তাকবিরে তাশরিক আরাফার দিনে অর্থাৎ যিলহজ্বের ৯ তারিখ ফযরের পর হতে শুরু হবে এবং শেষ হওয়া নিয়ে ইমাম আব হানিফা (রহ.) বলেন,‘নহরের’ দিন তথা ১২ তারিখ আসর পর্যন্ত। ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এর মতে বলেন, ‘‘আইয়্যামে তাশরিকের শেষ দিন হচ্ছে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত”। প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবির বলা। আর তাকবির হল এই-“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াাল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ্”।
ঈদের নামায কখন পড়বেঃ
ঈদের নামাযের সময় হচ্ছে সূর্য্য উর্ধ্বে উঠার পর থেকে পশ্চিমাকাশে যাওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত। এ নামায ঈদুল ফিতরের নামাযের মত। নামায শেষে ইমাম সাহেব দুটি খুৎবা পাঠ করবেন যা ক্বোরবানির মাসআলা-মাসাঈলে ভরপুর থাকবে।
মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনে আল্লাহতা’লা ইরশাদ করেন,“আমি প্রত্যেক দলকে এই উদ্দেশ্যে ক্বোরবানি করার নির্দেশ দেই যেন তারা ঐ নির্দ্দিষ্ঠ পশুগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারন করে যা তিনি তাদেরকে দিয়েছেন (সুরা: হাজ্ব)।
শরিয়তের পরিভাষায়:
আল্লাহ তালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের নিমিত্তে নির্দ্দিষ্ঠ সময়ে পশু যবেহ করাকে ক্বোরবানি বলে।
যাদের ওপর ক্বোরবানি ওয়াজিবঃ প্রত্যেক সুস্থ মস্তিস্ক, মুক্বিম ও মালেকে নেসাব স্বীয় প্রয়োজন ব্যতিরেখে অর্থাৎ খাওয়া, পরা, বাসস্থান ও উপার্জনের উপকরন ইত্যাদি ব্যতিত সাড়ে সাত তোলা সোনা বা বায়ান্ন তোরা রোপা কিংবা সমপরিমান সম্পদের অধিকারির উপর ক্বোরবানি ওয়াজিব।
ক্বোরবানির দিনঃ
ক্বোরবানির ইবাদত কেবলমাত্র তিনদিনের মধ্যে সীমিত। দশ, এগারো, এবং বারো যিলহজ্ব এ তিনদিন ক্বোরবানি করা যাবে। দশ যিলহজ্ব ঈদের নামাযের পর হতে বারো যিলহজ্ব সন্ধ্যা পর্যন্ত এই তিনদিনের যে কোন দিন ক্বোরবানি করা যাবে। (হেদায়া:৪/৪২৯)
ক্বোরবানির পশু কেমন হবেঃ
(১) ছাগল-ভেড়া, দুম্বা, গরু-মহিষ, উট ইত্যাদি গৃহপালিত পশু দ্বারা ক্বোরবানি করা শুদ্ধ। তাছাড়া হরিণ খরগোশ ইত্যাদি অন্যান্য হালাল প্রাণী দিয়ে ক্বোরবানি আদায় হবে না। (ফতওয়ায়ে আলমগিরি: ৫/২৯৫)
(২) ক্বোরবানির জন্য মোটা তাজা ও সুন্দর পশু ক্রয় করা মুস্তাহাব। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে, রাসুলে আকরাম (সা.) খুব সুন্দর হৃষ্ঠ-পুষ্ঠ পশু দিয়ে ক্বোরবানি আদায় করতেন। (ফতওয়ায়ে শামি:৫/২০৯)
(৩) অন্ধ, বধির, অতিরিক্ত দূর্বল, কানের বেশিরভাগ অংশ কাটা, লেজ কাটা পশু দ্বারা ক্বোরবানি জায়েয হবে না। (ফতওয়ায়ে শামি:৫/২৮২)
(৪) যেসব প্রাণী দিয়ে ক্বোরবানি দেয়া বৈধ নয় সেসব প্রাণীকে ক্বোরবানির নিয়তে যবেহ করা মাকরুহে তাহরিমি। (আলমগিরি)
(৫) যেসব পশুর শিং জন্মগতভাবে ভাংগা অথবা মধ্যভাগে ভাংগা তা দ্বারা ক্বোরবানি সহিহ হবে। আর যদি শিং গোড়া থেকে একেবারে নির্মূল করা হয়ে যায় তবে তা দ্বারা ক্বোরবানি জায়েয হবে না। (ফতওয়ায়ে শামি:৫/২৮০)
(৬) ক্বোরবানির পশু যদি বকরি হয়, তবে তা পূর্ণ এক বছরের হবে। আর যদি গরু-মহিষ হয় তবে তা দুই বছর হতে হবে। উট পাচ বছরের কম হলে ক্বোরবানি শূদ্ধ হবে না।
কিভাবে পশু যবেহ করবঃ
ক্বোরবানির পশুকে ক্বেবলামুখি শোয়াইয়া প্রথমে “ইন্নি ওয়ায যাহতু ওয়াযহিয়া লিল্লাযি ফাত্বারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন, ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার”। বলে যবেহ করতে হবে।
ঈদের নামাযের আগে ক্বোরবানি করা শুদ্ধ নয়। (কুদুরি:পৃ.১৯৮)
নিজের ক্বোরবানির পশু নিজ হাতে যবেহ করা উত্তম। নিজে না করলে সামনে থাকা ভাল। (আলমগিরি:৪/১০৬)
আল্লাহর নাম ব্যতিত অন্য নামে ক্বোরবানি করলে তা হারাম হয়ে যাবে। (ফতওয়ায়ে শামি:৫/৫১২)
ক্বোরবানির গোশত কি করবেঃ ক্বোরবানির তিনভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য, অন্যভাগ আত্মিয়-স্বজনের জন্য আর অপরভাগ গরিব-মিসকিনদের মধ্যে বন্টন করে দিবে। (শরহে বেদায়া:৪/৪৩৫)
চামড়া কি করবেঃ
ক্বোরবানির পশুর চামড়া দিয়ে জায়নামায, ব্যাগ বা যে কোন ব্যবহার্য পণ্য তৈরি করে নিজে ব্যবহার করা যেতে পারে। নতুবা এটা বিক্রি করলে তা গরিব-মিসকিনদের হক্ব হয়ে যায়। নিজের মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি কাউকেই চামড়ার টাকা দান করতে পারবেন না। তবে কি করবেন? এ প্রশ্নের সহজ জবাব এটা গরিবদের মধ্যে নিকটাত্মিয় গরিবই চামড়ার টাকা পওয়ার বেশি হক্বদার। তবে দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে দ্বিনদারিকে প্রাধান্য দেয়া খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে মাদ্রাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে দান করাটাই সবচেয়ে ভালো।