সতর্ক বিশ্বের চারপাশে যে আগুন

ফকির ইলিয়াস  ।।  হঠাৎ করেই কিছুটা বদলে গেছে নিউইয়র্ক মহানগরীর চেহারা। বড় বড় সড়কগুলো কোণায় কোণায় অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী পুলিশ। টাইমস স্কোয়ারের ব্যস্ততা চলছেই। ঘুর ঘুর করছেন গোয়েন্দারা। পাতাল রেলগুলোর স্টেশনে স্টেশনে তল্লাশির ছোট টেবিল। চাইলেই কাউকে চেক করে নিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। একই অবস্থা আমেরিকার অন্যান্য বড় বড় শহরেও। হোয়াইট হাউস আক্রমণের হুংকার এসেছে। তাই বসে থাকার কথা নয় তা যে কেউ বুঝেন। জীবন চলছে। চলবেই। সামনেই বড়দিন। ম্যারি ক্রিসমাস বলে বাজারে ছুটছেন নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ।

থ্যাংকস গিভিং ডে বা ধন্যবাদ জ্ঞাপনের দিন থেকেই মূলত শুরু হয়ে যায় ক্রিসমাস শপিং।

তারপরও মানুষের মনে যেন কোথায় এক আতঙ্ক! এক শঙ্কা! প্যারিসে যা ঘটেছে তা ভোলা যাবে না কোনোদিন। তারপরই মালিতে আক্রমণ করা হয়েছে। যারা আক্রান্ত হয়েছেন এদের অধিকাংশই বিদেশি। আমেরিকাররা প্রধান টার্গেট।

কি হচ্ছে? কি হতে পারে?

নিউইয়র্ক মহানগরীর পুলিশ কমিশনার বিল ব্রেটন বলেই দিয়েছেন সবাই সতর্ক থাকুন। নিউইয়র্কের পুলিশ সদস্য সংখ্যা ৩৫০০০। পুলিশ প্রধান বলেছেন, পাড়ায় পাড়ায় তো পাহারা সম্ভব নয়। আপনারা সাবধান থাকুন। চোখ-কান খোলা রাখুন। আপনার প্রতিবেশী কি করছে তা খেয়াল রাখুন। মানুষকেই সামনে এগোতে হবে।

এজন্য সাহস দরকার। শক্তি দরকার। এলাকায় এলাকায় সতর্ক থাকুন সবাই। বলেছেন নিউইয়র্কের পুলিশ প্রধান।

একটা ভয়াবহ সংঘাতের দিকেই কি এগোচ্ছে বিশ্ব? জাতিসংঘ বিশ্বের সব সামর্থ্য দেশকে আহ্বান জানিয়েছে, ইরাক ও সিরিয়ার ‘আইএস জঙ্গিদের’ বিরুদ্ধে সবকিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) দমনে আরো কঠোর হচ্ছে জাতিসংঘ। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা বিশ্ব সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে। এর ফলে খুব শিগগির আইএস বিরোধী অভিযানে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তি প্রয়োগ করতে দেখা যাবে। প্যারিস হামলার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রস্তাবনা পাস হলো নিরাপত্তা পরিষদে।

প্রস্তাবনাটি জাতিসংঘে উপস্থাপন করে ফ্রান্স। এতে আইএস দমনে ‘প্রয়োজনীয় সব’ পদক্ষেপ নিতে প্রস্তাব করা হয়। জাতিসংঘের ২২৪৯ নম্বর প্রস্তাবনাটিতে তিউনিসিয়ার সউসে ও তুরস্কের আঙ্কারায় হামলারও তীব্র নিন্দা জানানো হয়।

এ সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরাক ও সিরিয়ায় গেঁড়ে বসা আইএসসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনকে সমূলে উৎপাটন করতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ক্ষমতার শেষপ্রান্তে। ২০১৬ সালেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাই তিনি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইছেন না নিজেকে।

তিনি শান্তি চান। প্রশ্ন আসছে, মানবতা আগে না নিরাপত্তা আগে। সিরিয়া ও ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থীদের প্রবেশ কড়াকড়ি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আমেরিকান কংগ্রেস। আইন প্রণেতারা বলছেন, নিরাপত্তার খাতিরে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

২৮৯-১৩৭ ভোটে এ বিলটি পাস হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত করতে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের অর্থাৎ মার্কিন সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে। প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর প্রতিনিধি পরিষদের এমন একটি বিল তোলা হলো। তবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, তিনি বিলটিতে ভেটো দেবেন।

বিলটি আইনে পরিণত হলে পরবর্তীতে প্রত্যেক সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসী প্রত্যাশীর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের অনুমোদন পাওয়ার জন্য এফবিআই প্রধান, জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের সইয়ের প্রয়োজন হবে। ক্যালিফোর্নিয়ার রাজনীতিক কেভিন ম্যাকার্থি প্যারিস বলেন, এ বিল সন্ত্রাসবিহীন সমাজ তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।

শরণার্থী বিষয়ে নতুন করে ভাবছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে সিরীয় শরণার্থীদের সাহায্য করতে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক এজেন্সিকে এক বিলিয়ন ইউরো সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। তা ছিল এই সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। চলমান শরণার্থী সঙ্কট থেকে উত্তরণে ব্রাসেলসে ইইউ এর জরুরি সম্মেলনে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।

তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে ইউরোপিয়ানরা। সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোতেও আরো সহায়তা প্রদান করার কথা ছিল। কারণ, সিরিয়ায় সহিংসতা শুরুর পর সেখানে আশ্রয় নিয়েছে লাখ লাখ সিরিয়ান। সে সময় ইউরোপের সীমান্ত আরো জোরদার করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন ইইউ নেতারা। ইইউ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক জানিয়েছিলেন, অভিবাসীদের আরো বড় জোয়ার আসছে। তিনি বলেন, ‘দরজা এবং জানালা খোলা রাখার জন্য আমাদের সঠিক নীতি অবলম্বন করতে হবে।’

প্যারিস ও মালি হামলার মতো ঘটনা সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে। জঙ্গিদের এমন আচরণ হার মানিয়েছে সব মানবিক উচ্চারণকে। মার্কিন স্পিকার মি. পল রায়ন বলেছেন, ‘চলতি বছর সেপ্টেম্বরে ১০ হাজারের বেশি সিরিয় শরণার্থী নেয়ার বিলটি পাস হয়েছিল হোয়াইট হাউসে। কিন্তু আমাদের কাছে এখন জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আগে চিন্তা করতে হবে। আমরা শুনেছি, প্যারিস হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীরা সিরিয়া থেকে গ্রিস হয়ে ইউরোপে ঢুকে ছিল। এরকম আমাদের দেশেও আসতে পারে।’

অবাক করা বিষয়, এই প্যারিস হামলাকারীরা কোনো ইন্টারনেট যোগাযোগ না করেই কাজটি করেছে। তারা মৌখিক মাধ্যম কিংবা দেখা করে মিটিং করাকেই প্রধান সহায়ক হিসেবে বেছে নিয়েছিল। প্রযুক্তিনির্ভর এই বিশ্বকে তাক লাগিয়ে তারা এই আক্রমণ করেছে। এভাবে আরো করা হতে হতে পারে। এটা নিয়েই গোটা বিশ্ব এখন চিন্তিত।

এদিকে, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সিরিয়ায় আগামী দুই বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিকল্পনার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেছে।

কূটনীতিকরা বলেছেন, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো বাদ দিয়ে আসাদ বিরোধী কোন দলগুলোকে সিরিয় শান্তি আলোচনায় যোগ দেয়ার সুযোগ দেয়া হবে, তা নিয়ে ভিয়েনায় আলোচনার কথা ছিল। কিন্তু প্যারিস হামলার পর এই আলোচনার মোড় ঘুরে গেছে। এখন শুধু সিরিয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং আইএসকে কিভাবে সামরিক দিক দিয়ে পরাজিত করা যায়, তা নিয়েই আলোচনা চলছে।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ বলেছেন, এখন আমার উপলব্ধি হচ্ছে যে, আইএসের বিরুদ্ধে লড়তে একটি কার্যকর আন্তর্জাতিক জোটের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। রাশিয়া আসাদ বাহিনীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে সিরিয়ায় কয়েক সপ্তাহ ধরে বিমান হামলা চালাচ্ছে। তবে পশ্চিমা শক্তিগুলো অভিযোগ করেছে, রাশিয়া আইএসের চেয়ে পশ্চিমা সমর্থিত বিদ্রোহী মিলিশিয়া গ্রুপগুলোকে লক্ষ্য করে বেশি বিমান হামলা চালাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র আসাদের ভাগ্য নিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের মতবিরোধ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। এখন উভয় দেশ আইএস ইস্যুকেই প্রধান ইস্যু মনে করছে।

বিশ্বের চারদিকে এখন একটি আগুনের হলকা। এর নাম সন্ত্রাস। এর নাম জঙ্গিবাদ। ইসলাম কখনো এমন জঘন্য সন্ত্রাসকে সমর্থন করেনি। ইসলামের ইতিহাস তাই বলে। তাহলে যারা মসজিদের ভেতরেই আক্রমণ করে মুসল্লিদের মারছে, এরা কেমন শান্তি চায়?

যে বিষয়টি না বললেই নয় তা হলো, মালিতে জিম্মি প্রথম ২০ জনকে ধর্মের পরিচয় পেয়ে হামলাকারীরাই মুক্তি দেয় বলে কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম। কি ভয়ানক অবস্থার দিকে এগোচ্ছে মানুষর মানসিকতা !

তাহলে অন্য ধর্ম নিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না?

আজ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবার সময় এসেছে। প্রজন্মকে বুঝতে হবে ইসলাম কোনো রক্তপাত গ্রাহ্য করে না। এই ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে। না হলে এই আগুন থামানো কঠিন হতে পারে। কঠিন হতে পারে মানুষের জীবনযাত্রা। যারা ক্ষমতাবান তাদের দাঁড়াতে হবে শান্তিকামী মানুষের পাশে। কারণ, শান্তি ছাড়া কোনো উন্নয়নই এগিয়ে নেয়া যাবে না।

লেখক : কবি, কলাম লেখক।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts