মো. শহীদ উল্লা খন্দকার []
২ অক্টোবর। বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই দিনটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। কারণ এই দিনটিতে আমাদের জাতীয় পরিচয় সংরক্ষিত ও সমুন্নত রাখতে এক বিস্ময়কর যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। যে যুগে একটি ‘স্মার্টকার্ডে’ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশের নাগরিকদের পরিচয় লিপিবদ্ধ থাকবে। যা ভাবাও ছিল কঠিন। অথচ আমরা সে ভাবনাতেও এখন আর আটকে নেই, আমরা এখন সেই বিস্ময়কর জগতে। আর তা সম্ভব হয়েছে কেবল জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ডিজিটাল পরিচয় সম্বলিত স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করে বললেন ‘আমাদের জাতীয় জীবনে আজ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে।’
সত্যি, আজ আমরা এক নতুন অধ্যায়ে অবগাহন করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে কতখানি উন্নয়নের শিখরে নিয়ে গেছেন, তা বুঝতে এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট নয় কি! আমাদের রাজধানী ঢাকায় ফ্লাইওভার এবং মেট্রোরেলের যে কর্মযজ্ঞ চলছে, তা শেষ হলে আমরাই চিনতে পারবোনা আমাদের। পদ্মা সেতু শেষ হলে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পরিধিটা বেড়ে যাবে আরো। আমারতো মনে হয় উন্নয়নের পথে আমরা যেভাবে পথ অতিক্রম করছি, তাতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছুতে ২০৪১ পর্যন্ত সময়েরও দরকার হবেনা।
‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওর্য়াড’-নারীর ক্ষমতায়নে অসাধারণ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও দুটি অসামান্য পুরস্কার পেলেন। নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনা আবার বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করলেন। জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এ স্বীকৃতি পেয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘এই সম্মাননাকে বাংলাদেশের নারীদের জন্য সত্যিকারের পরিবর্তনের স্বীকৃতি। তিনি এই অ্যাওর্য়াড বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন খুব সহজ বিষয় নয় এবং কখনোই এটি স্বাভাবিকভাবে হবে না। তবে আমরা সাহস ও দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাব।’
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমি এমন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখি, যেখানে সকলেই নারীকে সম্মান জানাবে। যেখানে নারীর বিরুদ্ধে কোন প্রকার সহিংসতা ও বৈষম্য থাকবে না। তিনি মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখায় দেশের সকল নারী পুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই হচ্ছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। যঁাঁকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি, বুক ফুলিয়ে চলতে পারি।
সত্যিই যথার্থ বলেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন শুধু দলের নয়, তিনি সমগ্র বাঙালি জাতির প্রদীপ। কেবল প্রধানমন্ত্রীই নন, আমাদের মুখ উজ্জল করেছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও। সুদূরপ্রারী উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বিশ্বের সড়কে পৌঁছে দেয়ার স্বীকৃতি হিসেবে ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ফর আইসিটি’ পেয়েছেন।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগ বাস্তবায়নে অসামান্য অবদান ও প্রতিযোগিতামূলক টেকসই উন্নয়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে আইসিটির প্রতি তার অঙ্গীকার ও অসাধারণ নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এ পুরস্কার পান। তিনিও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের সম্ভবনাময় শক্তি দেশের সব তরুণদের উদ্দেশ্যে এই পুরস্কার উৎসর্গ করেন।
এসব পুরস্কারই আমাদের বলে দেয় আগামীর বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে। আমরা যে উন্নয়নের মহাসড়কে আগাচ্ছি, এটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই বলে দেওয়া যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাস শোষিত ও বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস। ত্রিশ লাখ প্রাণের আত্মত্যাগে, নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। এরপর থেকেই এগিয়ে চলেছে দেশ নানা রকম সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে। সমস্যার সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। রাজনৈতিক দুর্যোগ তো আছেই। যেটুকু অগ্রগতি সম্ভাবনা ভেসে ওঠে, তারও বারোটা বাজিয়ে দেয় এই রাজনৈতিক সংঘাত। সুখের কথা এতসব সমস্যা মোকাবিলা করেও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অতিক্রম করেছে ৪৫টি বছর। ইতিমধ্যে অনেক কিছুতে সুনামও অর্জন করেছে। খাদ্যে স্বনির্ভর হয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রসর অবস্থানে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক শিল্পে, নারীর ক্ষমতায়নে, বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। ক্রিকেটে, হিমালয় পর্বত আরোহণে সব স্থানেই বাংলাদেশ উজ্জল। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ভূমিকাও গর্ব করার মতো। এর সবই হচ্ছে আমাদের অর্জন।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা তৈরি হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার পক্ষেই মানুষের অবস্থান। পদ্মা সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। মানুষ দেশের উন্নয়নে এমন দৃঢ় মনোভাবই দেখতে চায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় নেতা থেকে বিশ্ব নেতৃত্বের দিকে ধাবিত হয়েছেন। বর্তমান বিশ্বের দশ জন সেরা নেতার মধ্যে তিনি অন্যতম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে তিনি একের পর এক বিপদ মোকাবেলা করে সফল হয়েছেন। বিশেষত বিডিআর হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার, যুদ্ধাপরাধের বিচার, সমুদ্র সমস্যার মীমাংসা, ছিটমহলের সমস্যা সমাধান, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন, বিশ্বব্যাংকের অপপ্রচার মোকাবেলাসহ দেশের অভ্যন্তরীণ সহিংস রাজনীতি ও হুমকি মোকাবেলা করে তিনি বিশ্বব্যাপি নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন। এমজিডি বাস্তবায়নের সাফল্য, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর করা, একুশ শতকের রূপকল্প ঘোষণা, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান এর সবই হচ্ছে তার সাফল্য।
এসব কারণে বাংলাদেশের প্রতি বহির্বিশ্বের আস্থা বেড়েছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভূমিকা ও দেশোন্নয়নের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন।
জাপানের জনপ্রিয় দৈনিক দ্য জাপান টাইমসে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বাংলাদেশ: এ নিউ ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম’ শীর্ষক একটি লেখা প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ সম্পর্কে জাপানিদের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বদলে যায়। এই লেখায় বলা হয়, জাতীয় গড় প্রবৃদ্ধি এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে, এবং এমনকি ৮০’র দশকের শুরুর দিকেও, অনেক পর্যবেক্ষক সংশয় প্রকাশ করেছিলেন দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকতে পারবে কি-না। কিন্তু আমরা তাদেরকে ভুল প্রমাণ করেছি। আর এটা বাংলাদেশের মানুষের দৃঢ়তা আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নানা সাহসী পদক্ষেপের সমন্বয়- যা ক্রমোন্নতির পথ উন্মোচন করেছে। আমাদেরকে নিয়ে গেছে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।’
লেখাটিতে বলা হয়, ২০০৫-২০০৬ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার সেটা বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ১৪৬৬ ডলার। দেশের দারিদ্র্যতার হার ১৯৯০ সালের ৫৬ শতাংশ থেকে কমে ২০১৫ সালে ২২.৪ শতাংশ হয়েছে। যা খুবই আশাব্যাঞ্জক সংবাদ।
বর্তমানে দেশজুড়ে আমরা ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক জোন (এসইজেড) স্থাপন করা হচ্ছে, যা ৪০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। একইসঙ্গে তা ২০৩০ সালের মধ্যে ১ কোটি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে বলে প্রত্যাশা রয়েছে।
এ থেকে এটি স্পষ্ট যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট একটি টার্গেট নিয়ে বাংলাদেশকে একটি স্বপ্নের দেশ গড়ার পথে তিল তিল নয়, দ্রুত গতিতেই যে ছুটছেন সেটাই দেখতে পাচ্ছি আমরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতোটা দ্রুত গতিতে ছুটছেন তা আমরা অগ্রগতির কয়েকটি দিকে চোখ রাখলেই দেখতে পাবো। ধরুন, নারী শিক্ষা। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নারীশিক্ষা বিনামূল্যে করা হয়েছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে স্নাতোকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত ১ কোটি ৭২ লাখ শিক্ষার্থী বিভিন্ন বৃত্তি কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে।
গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৬৮তম। আবার নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে এই অবস্থানটি সপ্তম। বর্তমান সংসদে ৭০ জন নারী রয়েছেন। স্থানীয় সরকারগুলোতে সাড়ে বারো হাজার নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদ নেতা, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের উপনেতাও প্রত্যেকেই নারী। রাজনীতি ও নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সাহসী নানা পদক্ষেপ এবং সামাজিক সচেতনতার সমন্বয়ে এটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
শিক্ষায় উন্নতির পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নবজাতক মৃত্যুর হার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি কমেছে। ১৯৯০ সালের হাজারে ৯৭টি মৃত্যু থেকে কমে তা ২০১৫ সালে ৩১ হয়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে দুই তৃতীয়াংশ। মানুষের গড় আয়ু ১২ বছর বেড়ে ৭১ হয়েছে।
রাজনীতিতে সক্রিয় এ মহান নেতা অল্প দিনেই মেধা ও মনন দ্বারা রাজনীতির গতিপথ পাল্টে দিয়েছেন। তিনি আজ তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। কেবল দেশীয় পরিপ্রেক্ষিতে নয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তিনি এক মহান ও উজ্জ্বলনেতা। শেখ হাসিনা আজ বিশ্বে নারীদের সংগ্রাম, উন্নয়ন ও নেতৃত্বের রোল মডেল। হাজারো প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশকে উন্নয়নের শীর্ষে নেয়া যায়, কেবল প্রগাঢ় বুদ্ধিমত্তা ও অসীম সাহসিকতা দিয়েই যে অর্থনৈতিক মন্দা, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটের মতো বিশ্বজনীন সমস্যারও সমাধান করা যায়, শেখ হাসিনা তা প্রমাণ করেছেন। অতএব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলা গড়ার শপথে কালের সারথী তিনি এবং তাঁর হাতেই কেবলমাত্র হতে পারে দিগন্ত বিস্তারি নব নব উন্নয়ন।
সত্যি কথা বলতে গেলে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জোরদার উদ্যোগ দেশের ঈর্ষণীয় অগ্রগতিতে শক্তি যুগিয়েছে। দেশ আজ দৃঢ়প্রত্যয়ী যে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। সে প্রত্যয়ের মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের ভবিষ্যতের সুখস্বপ্নে বিভোর হতে চাই।
লেখক : মো. শহীদ উল্লা খন্দকার, সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।