নির্মল চক্রবর্তী [] কবি হাসান হাফিজ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। আজ ১৫ সেপ্টেম্বর শনিবার তার ৬২তম জন্মদিন। ওর সঙ্গে আমার এতকালের বন্ধুত্ব, সেটা আমার অহংকার।
আমরা যারা ৭০ দশকের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম ,তাদের বেশ ক’জন এখনো আমার অন্তর জগৎকে নাড়া দেয়। আমি ছাড়া এ সকল বন্ধু সবাই খ্যাতিমান। এদের মধ্যে কবি, আমলা থেকে ব্যাংকার, অন্যান্য পেশায় ও প্রতিষ্ঠিত তারা। সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। যোগাযোগ রাখিও।
যাদের সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ, তাদের মধ্যে প্রতিদিন সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে নাস্তার টেবিলে কবি বন্ধু হাসান হাফিজের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। চলে আড্ডা। সেই আড্ডার মধ্যে আমার প্রিয় রাজনৈতিক কথাবার্তা। হাসান হাফিজ কবিতা ছাড়া অন্যান্য কোনো আলাপে যেতে চায় না কখনো, আমার চিন্তা উপলব্ধিতে কবিতা, বিভিন্ন প্রসঙ্গ স্থান পায়। হাসান হাফিজ উৎসাহ দেয়, বলে তুমি কবিতা লেখ, কিন্তু রাজনীতির আলোচনা, সমালোচনা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা নিয়েও তোমার লেখা ভালো। এইভাবে প্রতিনিয়ত হাসানের স্পর্শ আমাকে কাছে টানে। লেখার বিষয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, অন্য বন্ধুরা কেউ ওর মতো এভাবে বলে না। কিন্তু ওরাও লেখে।
প্রাক্তন সচিব কে এইচ এম মাসুদ সিদ্দিকী, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মাসুদুজ্জামান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আইয়ুবুর রহমান, কবি জাহিদ হায়দার, আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আহমদ বশীর, বিজ্ঞান কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল নূরজাহান, দৈনিক ঢাকা পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ইউনূস, ছড়াকার জহুরুল ইসলাম ঝরা তাদের সঙ্গে যখন মাঝে মধ্যে আড্ডায় মিলিত হই সবাই এক বাক্যে বলে হাসান হাফিজ এত কীভাবে লেখে।
শুধু লেখেই না, সম্পাদনাও করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বই। হাসান যখন ছিল দৈনিক বাংলার রিপোর্টার, তখন হাতেগোনা যে সকল রিপোর্টার ছিলেন ৮০-র দশকে, তাদের মধ্যে হাসানের নাম অগ্রগণ্য বললে ভুল হবে না।
আমি আমার বন্ধুদের কথা কখনো কারো কাছে বলি না, বলতে চেষ্টাও করি না। যেহেতু আমার ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকুরি নেই, যে পত্রিকায় চাকরি করি সে পত্রিকার মুখ বাংলাদেশের কেউ কালে ভদ্রেও দেখে না। কেউ কেউ হয়তো দেখেন, তা আমার জানা নেই। যার জন্য সব সময় লো প্রোফাইল মেইনটেইন করি। একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করার মতো।
আমার একমাত্র কন্যা শতাব্দী চক্রবর্তী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। নভেম্বরের মধ্যেই রেজাল্ট বের হবে ওর। বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসে, বই পড়ে নিয়মিত, রামায়ণ, মহাভারত, পদ্মপুরাণ, মনসা মঙ্গল থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের খ্যাতিমান লেখকদের বই কেনে, পড়ে।
বই পড়া ওর নেশা, শতাব্দী চক্রবর্তী যখন ৮ম শ্রেণীতে পড়ে, তখন ওকে নিয়ে বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় যাই। শতাব্দীর চোখে পড়ে হাসানের বেশ কয়েকটি বই। আমাকে বললো বাবা হাসান হাফিজ বড় মাপের কবি। আমি তার লেখা অনেক পড়েছি। এবার তার বই কিনবো। তুমি আমাকে অতিরিক্ত আরো ২ থেকে ৩টি বই কিনে দাও। অন্য বই দিলে নেবো না। বইগুলো অবশ্যি হাসান হাফিজের হওয়া চাই। আমি বললাম, হাসান হাফিজের বই কিনবো একটা। দুটো কিনবো না। ও তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শুধু নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাসমেট।
শতাব্দী বলে, বাবা তুমি তো মিথ্যা বলো না, যারা মিথ্যে বলে তুমি তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলো। এখন তুমি আমাকে মিথ্যে বলছো, কবি, লেখক হাসান হাফিজ তোমার বন্ধু। আমি বিশ্বাস করি না। কেন মিথ্যে বললে, এত বড় মাপের কবি তোমার বন্ধু হলে কবেই তো উনার নাম বলতে। আমি যতই বলি শতাব্দী ততবার বলে মিথ্যা কথা বাদ দাও। তখন বললাম শুধু হাসান হাফিজ কেন আমার অনেক বন্ধুই আছে, যারা খ্যাতিমান। কিন্তু আমি তো এতো বড় নই। রাজনীতি করতে যেয়ে আমলা হতে পারি নি, পারিনি ভালো মানের লেখক হতে।
এর মধ্যে বইমেলায় কবি, লেখক আমলাদের ভীড় বাড়তে থাকে। যারা কবি আমলা, তাদের মধ্যে অনেকেই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু। ভালো বন্ধু। আপদে বিপদে পাশে দাঁড়ায়। শতাব্দী দেখছে অপলক দৃষ্টি নিয়ে। তার চোখে মুখে উদ্ভাসিত হাসি। নিজেকে ধন্য মনে করছে।
শতাব্দী বললো, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আমলা তোমার বন্ধু। ভাবতে অবাক লাগে। তুমি কেন সচিব হলে না, কিছু হলে না। তুমি টোকাই কবি। এর মধ্যে কবি হাসান হাফিজ বইমেলায় ঢুকে গো। আমি ওকে দেখিনি। হাফিজই আমাকে দেখেছে। দেখেই বলে তুই কখন বই মেলায় এসেছিস? আমাকে তো বললি না। তোর কবি বন্ধু ড. মাসুদুজ্জামান কই, দেখা হয় কি? তুই তো আমলাপাড়ার মানুষ, এই বলে শতাব্দীর দিকে তাকালো। বললো ও কে?
বললাম আমার একমাত্র মেয়ে শতাব্দী। শতাব্দী তখনো জানে না যে, হাসানের সঙ্গেই আমার আলাপ হচ্ছে। শতাব্দী বললো বাবা এও কি তোমার কবি বন্ধু। বললাম তুমি যার বই বেশি পড়ো, এই সেই হাসান আংকেল। শতাব্দী বললো আপনি হাসান হাফিজ আংকেল? আসলে আমার বাবা কি আপনার বন্ধু? কি রকম বন্ধু? হাসান বললো বন্ধু বললো ভুল হবে। আমার একমাত্র সন্তান ডা. শিহান তাওসিফ গৌরব যখন জন্মায়, তখন তোমার বাবা বৃহত্তর সিলেটে একটি প্রতিষ্ঠিত সংস্থায় উচ্চপদে চাকরি করতো। লেখালেখি করতো মাঝেমধ্যে, দৈনিক বাংলায়। আমার সন্তানের জন্মের কথা শুনে ছুটি নিয়ে চলে আসে ঢাকায়, সোজা হাসপাতালে। তোমার বাবাই প্রথম ব্যক্তি, যে আমার সন্তানের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল নবজাতকের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস। এখন বোঝো তোমার বাবার আন্তরিকতা কতটা গভীর। শতাব্দীকে কয়েকদিন আগে বললাম সেই ছোট্ট গৌরব এখন রীতিমতো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। শমরিতা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার।
শতাব্দী সেই থেকে হাসানের লেখালেখির অনুরাগী। প্রতি বছর সে বই কেনে হাসানের। ওই বইমেলায় হাসান শতাব্দীকে বললো, তোমার বাবা চেইন স্মোকার। আমি বলেছি বন্ধ করো এসব। আমার কথা শোনেনি। তোমার উপর দায়িত্ব দিলাম। পরে আমি ধূমপান ছেড়েছি হাসানের মতোই, ওর অনুপ্রেরণায়। প্রতিদিন বাসায় যখন ফিরি, শতাব্দী বলে তোমার বন্ধুরা ভালো, সচিব শফিক আলম মেহেদী, সচিব ড.চৌধুরী বাবুল হাসান, ড. মাসুদুজ্জামান, ড. মোহাম্মদ সাদিক। যারা লেখালেখি করেন সবাই ভালো কবি। কিন্তু হাসান আঙ্কেলের বইয়ের সংখ্যা অনেক বেশি। এক শ’ ছাড়িয়ে গেছে কবেই! কীভাবে এত সুন্দর করে উনি লেখেন। তুমি কেন লেখো না। শতাব্দীর আবদার: প্রেম ভােলাবাসা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক লেখা লিখো।
বেশ কয়েক বছর পর হাসান তার একটি কবিতার বই উৎসর্গ করে শতাব্দী, ওর মা এবং আমাকে। বইটির নামও খুব কাব্যিক, তাৎপর্যবহÑ অপেক্ষা এক নদীর নাম। শতাব্দী তখন বললো বাবা হাসান আংকেল আসলেই তোমার খাঁটি বন্ধু। নইলে কি বই উৎসর্গ করতেন? হাসান চিন্তা চেতনায় কর্মে উদ্দীপনায় আরো অনেকদিন সুস্থ থাকুক, বেঁচে থাকুক, তার ক্ষুরধার লেখনীর বদৌলতে সমাজ উপকৃত হোক। হাসানের বিদুষী স্ত্রী শাহীন আখতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতী ছাত্রী। হাসানের লেখার পেছনে রয়েছে ওর মেধাবী প্রাণবন্ত স্ত্রীর অঢেল প্রেরণা।
হাসান হাফিজের জন্মদিনে ওকে আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই।