রহিমা আখতার কল্পনা []
এই চিঠিখানা আমাকে লেখা কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ-র প্রথম চিঠি । তৎকালে ঢাকার প্রকাশিতব্য ‘রাখাল’ পত্রিকার মুখপাত্র রুদ্র’র কাছে কিশোরগঞ্জ থেকে আমার লেখা চিঠির উত্তর । পাঠক , চিঠিতে দেখতে পাচ্ছেন তারিখ , বাংলা ২৯শে শ্রাবণ ‘৮৬ অর্থাৎ ১৩৮৬ । খামের উপর পোস্ট অফিসের সিল ইংরেজি 17 August 79 অর্থাৎ 1979 . আজ থেকে ৩৭ বছর আগে।
এই চিঠিটি ছিল তাঁর সাথে আমার সম্পর্কের অংকুর ।পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর সম্পর্কটি অন্তরঙ্গ হয়, অনেক গুজব- গুঞ্জনের জন্ম দেয় । কিন্তু একে ‘প্রেম’ বলা যাবে না কিছুতেই — আমি প্রথম তারুণ্যের মোহে আবিষ্ট ছিলাম , আর রুদ্র অন্যত্র প্রেমমগ্ন ছিলেন । আমার শুভার্থী বন্ধুরা সম্পর্কটি নিয়ে বিভ্রান্তিতে ছিল ।
পরে আমি জেনেছিলাম , আমাকে প্রথম চিঠি লেখার আগেই তিনি ময়মনসিংহে ভালোবাসার সূত্রে যাতায়াত করছেন , চিঠিতে সে প্রসঙ্গ উল্লেখিত আছে । প্রথমে বুঝিনি । যাক , এরপর তাঁর বিয়ে , বছর পাঁচেকের মাথায় ১৯৮৭ সালে বিয়ে-বিচ্ছেদ ।মাঝের এই পাঁচ বছরের ক্রান্তিকালে অন্য এক জনের সাথে আমারও একটি মানসিক সম্পৃক্তি। কিন্তু ১৯৮৮-৮৯ সাল থেকে আমরা আবার কাছাকাছি হতে থাকি, প্রকৃতই ভালোবেসে । মোহ তখন ভেঙে গেছে , একবার নিজের ভুলে ঠকে যাবার শোচনায় স্বভাবতই ভবিষ্যৎ-ভাবনা আমাকে অনেকটা সতর্ক করে তুলেছে ।
অবশেষে দীর্ঘ দিনের সংশয়ের বৃত্ত ভেঙে ১৯৯১ সালের ১৯শে জুন বুধবার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের ২৩৭ নম্বর কেবিনের সামনের বারান্দায় বসে দীর্ঘ প্রায় আড়াই / তিন ঘণ্টার নিভৃত কথামালার ভেতর দিয়ে আমরা একটি ঐক্যে মিলিত হই । বাকি জীবনের জন্য দু’জন দু’জনের জীবনসঙ্গী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই আমরা । রুদ্র’র ভাষায় ‘জীবনবদল’-এর সিদ্ধান্তে স্থির হই ।
হ্যাঁ , রুদ্র’র সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয় সেদিন । উপস্থিত ছিলেন রুদ্র’র প্রাণের আদৃতা বোন বীথিকা শারমীন , তাঁর স্বামী মণি ভাই , ছোট ভাই সাইফুল্লাহ (পরে ডাক্তার ), রুদ্র’র ডাক্তার বন্ধু ( যত দূর মনে পড়ে উনার নাম ডা. ইকবাল অথবা ডা. ফরহাদ ), রুদ্র’র খালা খালু ,ভাই বোনদের মধ্যে আরও দু’একজন ।মা তখনও এসে পৌঁছাননি , পথে — রওনা দিয়েছেন ঢাকার উদ্দেশ্যে । রুদ্র’র পরিবারের সদস্যরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন । পরবর্তী মাস খানেকের ভেতরে বিয়ে হবে বলে স্থির হয়, বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও পরিকল্পনা করেন রুদ্র নিজে ।
তার পরের দিন ২০শে জুন, রুদ্র ফিরে গেলেন ‘কুহু কানন ‘ এ , আমাদের শহরের ভাই ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ যে বাড়ির মালিক ।
তার পরের দিন ২১শে জুন ১৯৯১ ভোরবেলা বাংলা কবিতার ইতিহাসে একটি ভিন্ন মাত্রার উজ্জ্বল সূর্যের ডুবে যাবার দিন। যে সূর্য ডোবার সাথে সাথে আমার জীবনে নেমে আসে শ্বাপদসংকুল অন্ধকার । পরিণামে শুরু হয় ক্রমাগত দুর্যোগ-বিপর্যয় , দুর্ভাগ্য-নিগড় । যে দুর্ভাগ্যের বৃত্ত থেকে আমি আর মুক্তি পাইনি । আজো নয় ।
রুদ্র’র মৃত্যুর পঁচিশ বছর পার হওয়ার পর আজ তাঁর ষাটতম জন্মদিনে আমি প্রথমবারের মতো মুখ খুললাম । তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি ।
রহিমা আখতার কল্পনা
ডেপুটি ডিরেক্টর, বাংলা একাডেমি, ঢাকা