সৌরভ পাল []
”Better Late than Never”
তিন তিনটে দশক লেগে গেল। আকাশে জমতো কালো মেঘ, বৃষ্টি কভু হত না। বুলেটগুলো নিয়ম মেনে বুকে বিঁধে যেত, তবু বুলেটের বিরুদ্ধে গিটারটা ঢাল হতে পারত না! বড্ড দেরি হল ‘গিটারটাকে মান্যতা’ দিতে, তবে হল। একটা কঠিন পথ পেরিয়ে ডিলানের মাথায় উঠল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। ২০১৬-র সাহিত্য ক্যাটাগরিতে নোবেল পেলেন কিংবদন্তী মার্কিন গীতিকার বব ডিলান। ‘দ্য ত্যাম্বুরাইন ম্যান’। আমেরিকার বাউল বব ডিলান, জীবনের গান লিখেই জীবনের মুখপত্র হলেন।
“How many roads must a man walk down… Before you call him a man?”
“কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙ্গে যাওয়ার আগে? কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শিকল পরে।
কতটা পথ পেরোলো তবে পথিক বলা যায়?
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তাঁর ডানা?
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা…”
(ডিলানের কথাগুলোই সুমন যেভাবে সৃষ্টি করেছেন)
যে কথাগুলো লিখে একটা নোবেল হল ডিলানের, সেই কথাই তো ‘নোবেল কোম্পানি’ তৈরি করার আগেই লিখেছেন, গেয়েছেন ফকির লালন। রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যানের যদি গীতিকাব্য রচনা করে একটা নোবেলের অধিকারী হন, তাহলে লালনের কেন নয়? প্রশ্নটা এবার করতেই হচ্ছে। ‘নোবেল কোম্পানি’ প্রথম নোবেল দেওয়া শুরু করে ১৯০১ সালে (তখনও বিশ্ব যুদ্ধ দেখেনি পৃথিবী)। তারও একশো বছর আগে এই পৃথিবী পেয়েছে লালনকে। ফকির লালন সেই পৃথিবীর একমাত্র মানুষ, ‘যাঁর কোনও জাত নেই’। কৃষ্ণকথা যাদের জানা, তাঁরা নিশ্চয় জানেন জানকীর গর্ভে জম্ম আর যশোদার কোলে ‘লালন’ হয়েছে প্রেমেশ্বর কৃষ্ণের। ফকির লালনও তো তাই। হিন্দু মায়ের গর্ভে জন্ম আর লালনের লালন হওয়া মুসলিম তাঁতির ঘরে। এক জন্মে দুই জন্ম পাওয়া ‘গীতিকাব্যের প্রাণপুরুষ’ হলেন এই লালন ফকির। দেহ রেখেছেন ১৮৯০ সালে, তবে লালন আজও জীবিত, ভীষণ ভাবে বেঁচে আছেন প্রতি নিঃশ্বাসে। ‘গানে গানে তোমারে দিলাম, ভালোবাসার সেলাম’। কোটি কোটি কণ্ঠ আর হাত সেলাম করছে তাঁকে। অনবরত, অবিরত, ক্লান্তিহীন ভাবে।
গোটা পৃথিবীর কাছে লালনের অবয়ব মানে একটাই মাত্র স্কেচ। লালনের মৃত্যুর আগের বছর, ১৮৮৯ সালে যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ঐতিহাসিক সেই স্কেচই একমাত্র ছবি, যা দিয়ে লালনকে দেখা যায় চোখে। অবশ্য যে মানুষ চেতনায় থাকেন, তাঁর দর্শন তো ‘মনের চোখে’, আত্মদর্শনে। নিজেকে খোঁজার যে তত্ত্ব ওই অক্ষর না জানা মানুষটা স্রেফ মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন তাঁর জন্য একটা নোবেল কী প্রাপ্য নয়? ভাঙা হোক নিয়ম, মরণের পরও দেওয়া হোক নোবেল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পেয়েছিলেন গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদ করে (সাল ১৯১৩)। ১০৩ বছর পর কবিতা এবং গীতিকাব্য রচনার জন্য নোবেলে ভূষিত হলেন রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান ওরফে বব ডিলান। এর আগে এই ক্যাটাগরিতে নোবেল পেয়েছেন একমাত্র রবি ঠাকুরই। কবিতা, কাব্যগ্রন্থ, নাটক, ছোট গল্প এবং গান, এই সব কিছুকে এক আধারে যিনি নিয়ে এসেছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। উল্লেখ্য বাংলায় লিখে হয়নি, ইংরাজি অনুবাদ করেই নোবেলের দাবিদার হতে হয়েছে রবি ঠাকুরকে। আর যদি ভাষার ব্যারিকেড নাই থাকে তাহলে ডিলান পেলে লালন কেন নয়? সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে বিচার করলেও তো ডিলানের আদি পিতা থাকবেন লালনই। শুধু ডিলানই বা কেন, বিশ্ব কাব্যগীতিতে লালনই তো আদি পিতা এবং একমাত্র শিক্ষক। তাই নয় কী? অবশ্য ডিলান প্রসঙ্গ এই কারণেই, কারণ, ডিলান নিজেকে অ্যামেরিকান বাউল বলতেন এবং দ্বিতীয় ডিলান নোবেল পেলেন গীতিকাব্য রচনা করেই।
আরও একবার ডিলান প্রসঙ্গে ফিরে চলুন।
“ডিলান ইস এ গ্রেট লিরিক রাইটার। সাহিত্যের অন্যান্য ধারাতেও তিনি যেতে পারতেন। সাহিত্যের সব আঙিনাকে বাদ দিয়ে ডিলান কেবলমাত্র গান লেখার ঘরেই ঢুঁ মেরেছেন। গান যেভাবে লেখা হয়, পোয়েট্রির ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়না। কবিতার ক্ষেত্রে শিল্প একেবারেই পাঠ্যভিত্তিক। গানের আধার স্মৃতি। গান লেখার জন্য যে শব্দ ব্যবহার করা হয় কবিতার ক্ষেত্রে কিন্তু তা একেবারেই আলাদা, বব ডিলান পূর্ণতা পেলেন এখানেই”,
বব ডিলানের নোবেল প্রাপ্তির পর এমনটাই বলছেন রক তারকা রূপম। গায়ক ঊষা উত্থুপও একেবারেই গানের কথার ওপরই জোর দিয়েছেন।তাঁর মতে, “কোনও মানুষের হৃদয়ে পৌঁছেতে গেলে গানের কথাই হয় মূল আধার”।
আব্রাহাম মজুমদার (বাংলা ব্যান্ড ‘মহিনের ঘোড়াগুলি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য) বলছেন, “গায়ক ডিলান এবং লেখক ডিলন স্বতন্ত্র দুই সত্ত্বা। স্বাধীনতা মানে যে স্বেচ্ছাচারিতা নয়, ডিলনই আমাদের দেখিয়েছেন। শিশু মনকেও বুঝিয়ে দেবে ডিলনের গান, এতটাই সহজ”।
এবার একবার লালনের দিকে কানটা পাতুন। যে ভাষা যে কাব্য লালন রচনা করেছেন তাঁর তত্ত্ব ঠিক যতটাই গভীর, সারল্য যেন তার থেকেও বেশি। “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়, ভেবে অন্ত নাহি পাই…”, লালনের এই দর্শন আজও দুশো বছরের মতই একইভাবে বহমান। সেকালের সৃষ্টি একালেও একই রকম ভাবেই সজীব।
ডিলানের গানের ট্র্যাভেলিং
ব্যালাট সিংগিং, কাব্যগীতি, গান ফিরে ফিরে সুরে, সুরের কাঠামো- সময়ের পরিকাঠামো অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়েছে। ডিলন ভাবনা চিন্তা দিয়েছেন। কেউ সুর নিয়েছেন, কেউ কাব্য নিয়েছেন। নন ফিল্মিং মিউজিকে ডিলন একটা প্রতিষ্ঠান। একথা স্বীকার করতে কারো কোনও বিস্ময় কখনই হয়নি। নোবেল না পেলেও হত না। একই কথা ফকির লালনের জন্যও প্রযোজ্য।
শেষ করব দুই নোবেল জয়ীর এক সমুদ্রে এসে মেশার কাব্য দিয়েই। রবীন্দ্রনাথ দিয়েই বলি প্রথমে, ‘বাউলাঙ্গে রবীন্দ্রনাথ’। “হরি কী দিয়ে বল…” রবীন্দ্রনাথ কাব্য দিয়েছিলেন, সুর দিয়েছিলেন নবনী দাস ‘ক্ষ্যাপা’। দ্বিতীয়জন বব ডিলন। যার কলকাতা কানেকশন একমাত্র বাউলের টানেই। দুই বিশ্বজয়ীর মন্ত্রে মন্ত্রে গানে গানে রন্ধ্রে রন্ধ্রে যাঁর কথা, ভাবনা ফিরে ফিরে এসেছে তিনি কী লালন ছাড়া আর কেউ? আর যদি তাই হয়, নোবেল বোধহয় অপেক্ষা করছে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছনোর। লালনের কাছে পৌঁছে যাক নোবেল।
গান হোক এমনও, “Let me thank for knowing you. Hey Lalon Fakir…