এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

মো. শহীদ উল্লা খন্দকার  [] গত অক্টোবর ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি অগ্রগতির মাইলফলক। তিন দশক পর চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর এবং বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখতে আসা, দুটো ঘটনাই ছিল আশাব্যঞ্জক। দুটো ঘটনাতেই বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে এবং বাংলাদেশের অগ্রগতি কতখানি সে দিকটি বিশেষভাবে জনসমক্ষে এসেছে। বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ এখন কতটা সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম এর বক্তব্য এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলা টুইট-ই তার প্রমাণ বহন করে। সমস্ত কিছু পার করে আমরা এখন শান্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছি।  সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব।

 

চীনের মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা প্রজ্ঞা সমৃদ্ধি এসব অর্জন ততটা না থাকলে হুট করে কারো প্রশংসায় বিগলিত হন না। আর না হোক কর্মবিমুখ জাতি মোটেই পছন্দ নয় তাদের। সে দেশের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এলেন। বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করলেন। এমন কী চীনের বৃহত্তম পত্রিকা পিপলস ডেইলির একটি বিশ্লেষণির শিরোনাম ছিল : ‘শি জিনপিং-এর বাংলাদেশ সফর ঐতিহাসিকভাবে তাত্পর্যপূর্ণ।’ এ পত্রিকার কলামটিতে বলা হয়েছে, চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কের মাইলফলক হয়ে থাকবে। দু দেশের মধ্যে উপকূলীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকে সই হলো। চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের এই সফরের কারণে প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা পাচ্ছে বাংলাদেশ। বড় অঙ্কের এই ঋণে বাংলাদেশে বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্র, একটি সমুদ্রবন্দর এবং রেল অবকাঠামোর উন্নয়ন হবে। যা নিঃসন্দেহে অনেক বড় অর্জন আমাদের।
বলা হচ্ছে চীনা প্রেসিডেন্ট যে রকম বিপুল বিনিয়োগ নিয়ে এসেছেন এই সফরের সময় সেটা একটা রেকর্ড। চীনা প্রেসিডেন্টের কথায়, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এক নতুন ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বন্ধু হিসেবে পাশে থাকতে চীন প্রস্তুত। ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কের পর্যায় থেকে দুদেশের সম্পর্ক এখন কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্কে উন্নীত হবে।

 

চীনের প্রেসিডেন্ট একাই আসেননি, সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ৮০ সদস্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের বিশাল লটবহর। তারা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা খুশি যে, এর ফলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ সামনের দিনগুলোতে আরো বাড়বে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে চীনের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের ১৩টি চুক্তি হয়েছে। এই ১৩টি চুক্তিতে প্রায় এক হাজার তিনশ ষাট কোটি ডলার বিনিয়োগ হবে। এসব কী কখনো হুট করে হতে পারে! আসলে এর সবই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার দক্ষতারই ফসল।  শি জিনপিং এর সফর মূলত শেখ হাসিনা সরকারের বিদেশনীতিরই একটা সফলতার অংশ। গত কয়েকদিন ধরে গণমাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নিয়ে নানা ধরনের প্রচারণা আসছে যা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সফলতারই বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই চীনসহ সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়ন বিস্ময়।

 

বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের বাংলাদেশ সফরেও লাভবান হয়েছে বাংলাদেশ। তাঁর সফরে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মাঝখানে ঝুলে থাকা একটি অস্পষ্টতার মেঘ কেটে গেল। বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবসকে সামনে রেখে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতিতে মুগ্ধ তিনি। বাংলাদেশের এই অগ্রগতির প্রশংসা করে বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেন, এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্য দেশও সুফল পাবে। দারিদ্র্য বিমোচনে পথ দেখাবে বাংলাদেশ।

 

বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে অতিদারিদ্র্যের হার যেখানে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল, তা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। তার বর্ণনায় বাংলাদেশের এই অর্জন ‘চমত্কার’। জিম ইয়ং কিম বলেন, ‘জনগণের পেছনে বিনিয়োগ করা ঠিক ততটাই জরুরি, যতটা জরুরি অবকাঠামো ক্ষেত্রের বিনিয়োগ।’ অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সেই বিনিয়োগ বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় তিনি বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেন, ‘দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। সেটি সেলিব্রেট করতেই আমি বাংলাদেশে এসেছি।’

 

দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে তিনি আরো বলে গেলেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতার অভিজ্ঞতা বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দিতে বিশ্ব ব্যাংক একটি ‘মাল্টি-ডোনার ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠনের পরিকল্পনা করছে। কেবল কী তাই, বাংলাদেশকে নতুন করে তিন বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যান বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট। এর ১ বিলিয়ন ডলার শিশু অপুষ্টি দূর করতে এবং বাকিটা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায়। আমাদের ‘উন্নয়ন’ নামক গাড়ির চাকা এখন প্রচণ্ড ঘূর্ণায়মান। আর এ গাড়ির স্টিয়ারিংও এখন সঠিক হাতে, এটাও বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন জিম ইয়ং কিম। তাই তিনি বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতি তার ‘পূর্ণ আস্থার’ কথাও জানিয়ে গেলেন।

 

বাংলাদেশের নিরাপত্তায়ও ‘অভিভূত’ বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট। বাংলাদেশ সফরে যে নিরাপত্তা পেয়েছেন তার ভূয়সী প্রশংসা করেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। দুই দিনের সফর শেষে ঢাকা ছাড়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি আপনাদের এটাই বলতে পারি, যে নিরাপত্তা আমি পেয়েছি তা খুবই চমত্কার।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বে একটি দেশও নেই, যেটা সন্ত্রাসী হামলা থেকে মুক্ত। এটা সমাজের একটি দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা।’ জিম ইয়ং কিমের এই প্রশংসা বিদেশের অর্থদাতাদেরকেও বাংলাদেশের প্রতি আস্থাবান করে তুলবে। গুলশান হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বাংলাদেশের প্রতি বিদেশিদের মনে যে প্রশ্নবোধকের ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে জিম ইয়ং কিমের এই অভিব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আবারো ফিরিয়ে আনবে।
বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে সফরের অংশ হিসেবে বরিশাল গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি অভিভূত হলেন মাঠপর্যায়ে কর্মরত পরিশ্রমী মানুষদের দেখে। তিনি দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামে যান। প্রায় একঘণ্টা রাকুদিয়া গ্রামে অবস্থান করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ওই গ্রামের কয়েকটি বাড়ির ক্ষুদ্র গরু ও হাঁস-মুরগির খামার, পুকুরের মাছ চাষ, বাড়ির আঙিনা এবং পতিত জমিতে সবজি ও ফসলের চাষ, কম্পোস্ট সার তৈরি করে ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তার মাধ্যমে দারিদ্র্য জয়ের চিত্র। এ সময় তিনি গ্রামের দারিদ্র্য জয়ী নারীদের কাছ থেকে তাদের অর্জিত সাফল্যের গল্প শুনেন।

 

গ্রামের নারীদের ভাগ্যবদল ও দারিদ্র্য জয়ের চিত্র স্বচক্ষে দেখে অভিভূত বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করেন, ‘বাঙালিরা অত্যন্ত পরিশ্রমী, তারা কাজ করতে পারে, পিছিয়ে পড়ে না। বরিশালে এসে আমি খুব খুশি হয়েছি। এখানে আমরা বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করছি। আগে এখানকার নারীরা অতিদরিদ্র ছিল। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল না। তিনি আরো বলেন, গরু পালন, মাছের চাষ করে তারা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা আগে স্কুলে যেত না। এখন যাচ্ছে। সবকিছুই ভালো লেগেছে। আমরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে আরো অর্থ দিয়ে সহায়তা করব।’ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট স্বচক্ষে দেখে আমাদের শ্রম ও নিষ্ঠাকে যেভাবে প্রশংসায় ভাসালেন, তাতে একজন বাংলাদেশি হিসেবে মন ভরে যায় আমারও। নিজেদের গর্বিত মনে হয়।
বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বরিশালে একই ভবনে একসঙ্গে স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার ও সাইক্লোন সেল্টার দেখেও মুগ্ধ হলেন। তার কাছে এটি ছিল অভাবনীয় বিষয়। মুগ্ধ জিম ইয়ং কিম এবার প্রশংসা করে বলেন, সামনে বাংলাদেশের জনগণের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ অপেক্ষা করছে। আসলে কিমের এই ঢাকা সফর ছিল দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশের সাফল্যেরই ‘স্বীকৃতি’।
বাংলাদেশ গত এক দশক আগ পর্যন্ত বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি ছাড়া নিজের জাতীয় বাজেট পর্যন্ত যেখানে পেশ করতে পারত না। সেই বাংলাদেশের দিকে আজ তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব। যেখানে সমগ্র পৃথিবীর দ্বারে দ্বারে ঘুরে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের রাজি করানো ছিল এক বিশাল কষ্টসাধ্য বিষয়, আজ সেখানে অনেকটা আমরা না চাইতেই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে আসছে আমাদের কাছে।
আমি মনে করি, এ অর্জন শেখ হাসিনার সরকারের দেশপ্রেমেরই ফসল। আর তাই কেবল বিশ্বব্যাংক নয়, সমগ্র পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছে আজ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশকে, যে দেশে একের পর এক সফর করছেন বিশ্বনেতারা, অর্থের ডালা নিয়ে আসছেন বিনিয়োগের জন্য এবং সেই সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য। সব মিলিয়ে বুক ফুলিয়ে আজ এটাই বলতে পারি, আমরা আর কারো কাছে মাথা নোয়াবার নই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের মতো করেই।

 

n লেখক : সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Print Friendly

Related Posts