সতু, সরে আয়, গাড়ি আসছে।
দূর! গাড়ি নয়, দুটো মোটরবাইক পাশাপাশি আসছে।
কী করে বুঝছিস?
ও সব বোঝা যায়। মাতাল কি কখনও অ্যাক্সিডেন্টে মরে রে?
কে বলল মরে না?
আমিই বলছি, আবার কে বলবে? কখনও খবরের কাগজে দেখেছিস, দুর্ঘটনায় মাতালের মৃত্যু?
না, তা দেখিনি। তুই অনেক জানিস বটে।
আলবাত জানি।
যাঃ! হেডলাইট দুটো নিবে গেল?
তোর মাথা! দুটোই টার্ন নিয়ে অন্য দিকে চলে গেছে।
ওরে সতু, এ বার একটা ট্রাক! সরে আয়।
আরে দূর, আমরা তো ধার দিয়েই যাচ্ছি। বাঁ দিকে আরও সরলে যে মুগবেড়ের খাল!
খাল! বাঁ দিকে খাল কোত্থেকে আসবে? খাল তো ডান ধারে!
আমরা কোন দিকে যাচ্ছি বল তো?
পুব দিকে। উত্তরে খাল।
তোর মাথা। আমরা যাচ্ছি পশ্চিম দিকে।
কী করে বুঝলি?
ও সব বোঝা যায়।
তুই কি এ জায়গা চিনিস?
চিনব না মানে? এ খাল গেছে বিষ্টুপুর। পবন বৈরাগীর হবু শ্বশুরবাড়ি। আর আমরা হলুম গে বরযাত্রী। দেখ, সব ঠিকঠাক বলছি তো?
তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু দেখলি, ট্রাকটাও কেমন ধাঁ করে ঘুরে গেল!
ট্রাক শালাদের কি দিগ্বিদিক জ্ঞান আছে? যখন যেখানে খুশি ঢুকে যায়।
দেখ সতু, আমার কান কিন্তু খুব সজাগ। আমার বউ বলে, আমি নাকি ছুঁচ পড়ার শব্দও শুনতে পাই। আমি কিন্তু খালের জলের শব্দটা আর শুনতে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আমরা ভুল রাস্তায় যাচ্ছি।
তা হলে তোর চোখ খারাপ।
চোখ কেন খারাপ হতে যাবে?
যাদের কান ভাল হয় তাদের চোখ খারাপ হবেই।
দূর শালা, এমন কোনও আইন আছে নাকি?
নেই মানে? আলবাত আছে। এ তো সবাই জানে যে, যার চোখ ভাল সে কানে খাটো, আর যার কান ভাল তার চোখ কানা, হুঁ হুঁ বাবা, এক্কেবারে খনার বচন।
দ্যাখ সতু, আমার কিন্তু একটা কথা মনে হচ্ছে।
কী কথা?
তুই মাতাল হয়েছিস।
তোর দোষ কী জানিস শিবু?
কীসের দোষ?
তোর দোষ হল তুই আমাকে বিশ্বাস করিস না।
কিন্তু কাশীশ্বর তো আর ভুল কথা কইতে পারে না!
কাশীশ্বরটা কে?
পবনের হবু শালা। যে পইপই করে বলে দিয়েছিল খালটা বাঁ ধারে রেখে বরাবর এগিয়ে যেতে, লালবাবুর মুরগির খামারের পাশ দিয়ে রাস্তা।
তোকে একটা কথা বলার আছে। মন দিয়ে শোন। কখনও শুনেছিস কোনও মাতাল কখনও পথ হারিয়েছে? মাতাল সব সময়েই জায়গা মতো পৌঁছে যায়। যারা মদ খায় না তাদেরই যত গন্ডগোল। তারাই পথ হারিয়ে ফেলে, ভুলভুলাইয়াতে ঘুরপাক খায়। বুঝলি?
হুঁ। সামনের অন্ধকারটা দেখেছিস? একেবারে দইয়ের মতো জমে আছে। চামচে দিয়ে ঘপাৎ করে তুলে আনা যায়।
অন্ধকার! অন্ধকার কোথায়? আমি তো দিব্যি রাস্তা দেখতে পাচ্ছি। তুই ফের টর্চবাতিটার কথা তুলতে চাস বুঝি?
তা কথাটা কি মিথ্যে? হিন্দু মণ্ডল নেপাল থেকে এনে দিয়েছিল। ষাট টাকা দামের টর্চ। ব্যাটারি কিনতে হয় না, চার্জ দিলেই হয়। অমন একটা হরিপদ জিনিস তুই বাসে ফেলে এলি?
ওরে, ও রকম কত যায়। টর্চের জন্য শোকতাপ করিসনি তো। ষাট টাকা তো! লাল গরুটা বেচে তোকে টাকাটা দিয়ে দেব।
তোর গরু গত সাত মাসেও বিক্রি হয়নি। লাল গরু আর কত দেখাবি বাপ? পল্টু হালদারের কেরাসিনের দোকানে তোর নাকি দেড়শো টাকা ধার। পল্টু বলছিল তাকেও নাকি লাল গরুর কথা বলে রেখেছিস।
তোর দোষ কী জানিস? বড্ড ছোট মাপের কথায় আটকে থাকিস। একটু বড় বড় জিনিস ভাবতে শেখ দিকি। টর্চবাতি! কেরোসিন! ছ্যাঃ ছ্যাঃ। এ সব কি একটা পুরুষমানুষের ভাবনার কথা হল? ও সব হল পিঁপড়ে, ঝেড়ে ফেলে দে।
তা না হয় ফেললুম। কিন্তু এখন বিয়েবাড়িতে পৌঁছনোর কী হবে তা ভেবে দেখেছিস! গিরিধারী সাধুখাঁর বাড়ি বললে লোকে দেখিয়ে দেবে বলেছিল, তা লোকজনও কাউকে দেখছি না। বিয়েবাড়ি হলে আলো-টালোও তো চোখে পড়ার কথা! অন্ধকারে তো নিশ্চয়ই বিয়ে হচ্ছে না।
কথা একটু কম করে দেশলাইটা এক বার জ্বাল না!
দেশলাই জ্বেলে কি পথ দেখবি নাকি? এই যে বললি, তুই দিব্যি পথঘাট দেখতে পাচ্ছিস! আর গেদে বিষ্টুপুরও তোর চেনা জায়গা!
দুটোই ঠিক। তবে কিনা বিকেলে তেড়ে বৃষ্টিটা হয়ে গেল যে! তাতেই একটু গুলিয়ে গেছে। আষাঢ় মাসে কারা বিয়ে করে জানিস? আহাম্মকেরা! পবনকে তো তখনই বলেছিলুম, ওরে এই বিয়েতে রাজি হসনি, মেয়ের বাবার একজিমা আছে। তা শুনল আমার কথা! কারও ভাল করতে নেই, বুঝলি!
কার একজিমা আছে? গিরিধারী সাধুখাঁর?
তবে আর কার?
তুই কী করে জানলি?
ও জানা যায়।
গিরিধারীকে আমি চিনি। ওর মোটেই একজিমা নেই।
নেই?
না। আর একজিমা থাকলেই বা। তাতে বিয়ে আটকায় কীসে?
ওরে, একজিমা থাকা কি ভাল?
তা বলিনি। তবে বাপের একজিমা থাকলে মেয়ের বিয়েতে কোনও বাধা নেই।
অর্শায় না?
তোকে বলেছে।
সাধুখাঁরা কি লোক ভাল হয়?
কেন, সাধুখাঁ আবার কার পাকা ধানে মই দিয়েছে?
সে তুই যা-ই বলিস, আমার মনে হয় সাধুখাঁরা তেমন সুবিধের লোক নয়। নইলে কি আষাঢ় মাসে মেয়ের বিয়ে দেয়?
দেখ সতু, সেই কবে থেকে তোকে বলে আসছি, একটু মেপেজুখে খা। মাল অন্যের হলেও নৌকো তো তোর! পবনের জ্যাঠার পয়সায় খেলি বলে বোতল সাবড়ে দিলি? মদ চাগাড় দিলে কি আর মানুষ, মানুষ থাকে রে? তুই দিব্যি মাতাল হয়ে গেছিস।
কী করে বুঝলি? একটাও উলটোপালটা কথা কয়েছি? নাকি পা টলোমলো করছে? এই তো দিব্যি সটান ভদ্রলোকের মতো হেঁটে যাচ্ছি! মাতাল বলে কেউ বুঝতে পারছে, কালীর দিব্যি খেয়ে বল তো!
উলটোপালটা বলছিস। পা-ও টলছে।
এত বড় মিথ্যে কথাটা বলতে পারলি শিবু? তোর যে জিভ খসে পড়বে রে! পড়বে কেন, আমার তো মনে হচ্ছে তোর জিভ খসে পড়ে রাস্তায় কই মাছের মতো তড়পাচ্ছে! টর্চটা জ্বেলে একটু খুঁজে দেখ তো!
টর্চ জ্বালতে গেলে কম করেও একটা টর্চের তো দরকার হয়, নাকি?
তোর একটা দোষ কি জানিস শিবু? তুই বড্ড পুরনো কথায় আটকে থাকিস। এখন কি তোর টর্চের কথাটা তুলে খোঁটা দেওয়া উচিত হচ্ছে? সামনে একটা গুরুতর কাজ!
গুরুতর কাজটা কী?
কেন, পবনের বিয়ে!
হুঁ, সে তো বুঝলুম। কিন্তু তুই কোন আক্কেলে বাসরাস্তা ছেড়ে সাইডের রাস্তাটা ধরলি সেটা বলবি তো! সামনে তো যমপুরীর অন্ধকার। বিয়েবাড়ির কোনও নামগন্ধও তো দেখছি না!
আমি তো তোকে তখন থেকেই বলে আসছি যে সাধুখাঁরা লোক তেমন সুবিধের নয়। ওরা ইচ্ছে করেই ভুল ঠিকানা দিয়েছে।
মাতালদের নিয়ে কোথাও কি যেতে আছে? লালবাবুর মুরগির খামারটাই তো এখনও দেখা গেল না। নাঃ, তোর ওপর ভরসা করাটাই ভুল হয়েছে। কেন যে বললি তুই গেদে বিষ্টুপুর হাতের তেলোর মতো চিনিস!
দ্যাখ শিবু, আমি কিন্তু মিছে কথা কই না। এই গেদে বিষ্টুপুরের প্রাণহরি মজুমদারের মেয়ে প্রণতির সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। সেই সুবাদে বিস্তর যাতায়াত, বলতে গেলে গেদে বিষ্টুপুর এক রকম আমার শ্বশুরবাড়িও বটে! আর শ্বশুরবাড়ির গাঁ আমি চিনব না!
এ হল মামার গোয়ালে বিয়োলো গাই, সেই সম্পর্কে মামাতো ভাই। বিয়ের প্রস্তাব আর বিয়ে কি এক জিনিস? তা বিয়েটা হল না কেন?
হয়েই গিয়েছিল প্রায়। বিয়ের পিঁড়িটা আর মাত্র দশ ফুট দূরে। আমি হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছি। ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে একটা ছোকরা এসে পট করে পিঁড়িতে বসে মাথায় টোপর পরে কানে মন্তর আওড়াতে শুরু করল।
অ! তা তোর হামাগুড়ি দেওয়ার কী হল বল তো!
কেন, হামাগুড়ি দেওয়ায় দোষটা কি দেখলি? মাঝে মাঝে কি আমরা হামাগুড়ি দিই না? আমার হামাগুড়ির স্পিড কিছু খারাপও নয়। প্রায় পৌঁছেও গিয়েছিলাম। আমার বাপ-খুড়োরা এখনও বলে, ইস, আর একটুর জন্য তুই পিঁড়িটাতে উঠতে পারলি না!
বিয়ের সময় কি কেউ হামাগুড়ি দেয়? হামাগুড়ি দিলি বলেই তো বিয়েটা কেঁচে গেল!
তোর একটা দোষ কি জানিস? মানুষের ভালটা এখনও দেখতে শিখলি না। আমি কেমন হামাগুড়ি দিই দেখবি? দেখলে চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।
তাই দে বাপু, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাহয় তোর হামাগুড়ি দেওয়াটাই দেখি। বিয়েবাড়ির চেয়ে আর কতটাই বা খারাপ হবে?