এএইচএম নোমান ।।
এ বছরের ১০ ডিসেম্বর ২০১৫ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ৬৮ বছরে পা দিল। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশী ৩৬০ ভাষায় অনুবাদকৃত দলিল হিসাবে মানবাধিকার শিক্ষা ও জ্ঞান সর্বত্র ছড়িয়ে এটা আজ মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করার জীবন্ত দলিল। রাজনৈতিক বা জনগোষ্ঠির অগ্রগতির একটি সাধারন মানদন্ড হিসেবে মানবিক অধিকারসমূহের এই সার্বজনীন ঘোষণাপত্র জারী যদি সত্যিকার অর্থে ব্যবহারিকভাবে কাজে লাগানো যায় তা ধনী ও উন্নয়নশীল বিশ্বের ধনী-দরিদ্র উভয়ের কাছে সত্যিকার অর্থে সার্বজনীন করে তোলে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এ সকল মৌলিক বিষয়সমূহে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠাই মানবাধিকার।
বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে আরো সহজ ভাবে বলা যায়, দারিদ্র বিমোচন করাটাই হলো সত্যিকারের মানবাধিকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পদের সুষম বন্টনের জন্য দূর্নীতিমুক্ত ভাবে অর্থবহ ও কার্যকর কর-ধার্য, আদায় ও এর পরিধি বাড়াতে হবে। স্ব সম্পদে দেশজ চিন্তায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় মানবাধিকার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যার বিশাল দৃষ্টান্ত ‘পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করবো’ এর দৃঢ়তা। তবে সমতার ভিত্তিতে নিজের পায়ে দাড়াতে হবে।
শুধু করপোরেট রেসপনসিবিলিটি বলে দান খয়রাতের কথা বললে হবে না। এটা সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার সকলের বিশেষ করে বঞ্চিত গরীবের প্রাপ্য অধিকার। এ অধিকার আদায় করতে হবে।
২০০৯ জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার মিজ নাভিও বলেছেন, ‘বর্তমান বিশ্বে বৈষম্য বহুমুখী আকার ধারন করেছে। যে ব্যাক্তি নিজে বৈষম্য শিকার হয় না তার পক্ষে এর ফলে সৃষ্ট দূর্ভোগ অনুধাবন করা নিতান্তই কঠিন’। আজকের দিন উদযাপনের আগেও একইভাবে জাতিসংঘ বৈষম্য অবসানের গুরুত্ব দিয়ে বলেছিল ‘All human beings are born free and equal in dignity and rights’. আমাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা সকলের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা চাই এবং তা বৈষম্য দূরীকরন ও ন্যায্যতা সৃষ্টির মাধ্যমেই সম্ভব।
এ বছরও (২০১৫) জাতিসংঘ একটু ঘুরিয়ে Our rights, Our Freedoms, Always প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে। এই প্রসঙ্গে ২০০২ এ জেনেভাস্থ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে আমি বাংলাদেশের ‘জনগণের স্বাস্থ্য আন্দোলন’র চেয়ারপার্সন হিসেবে একটি প্রতিনিধি দল মে মাসে যোগদান করি। সে বছর হু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আসুন, শরীরটাকে সচল রাখি’। সম্মেলন কক্ষে এক পর্যায়ে সঞ্চালক দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবাইকে শারিরীক ব্যায়ামের কিছু কসরৎ অনুশীলন করান। তাৎক্ষনিকভাবে সম্মানীত উপস্থিতিদেরকে বল্লাম যে, আমাদের দেশে (বাংলাদেশ) প্রায় প্রতিটি লোকই ভোর রাতে কাকডাকা সকালে বা মসজিদে আযান দিলে বিছানা ছেড়ে জেগে উঠে এবং যার যার কাজে যেমন প্রার্থণা, কৃষি কাজ, শ্রমকাজ ইত্যাদি ভাবে মাঠে ঘাটে নেমে যায়। এভাবেই সাধারনভাবে প্রায় সকলের শরীর সচল থাকে। তাই যার যার দেশের আঞ্চলিক, ভৌগলিক স্বাস্থ্য শিক্ষাকে হিসাবে রেখেই তার তার প্রতিপাদ্য ঠিক করাই প্রযোজ্য। পরবর্তীতে আলোচনায় এইভাবেই আসে যে, বিশ্ব প্রতিপাদ্যকে মূল রেখে স্ব স্ব দেশে এমনকি আঞ্চলিক, পরিবার ও ব্যাক্তি পর্যায়েও প্রয়োগিক কার্যকর বিষয় নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
একইভাবে ২০১১ সালে কানাডার টরেন্টোতে টরেন্টো ওম্বাড্সম্যান আয়োজনে ঐ বছর ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় আমি অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। ঐ দিনের আলোচনায় কানাডার শিক্ষার অধিকার নিয়ে মূল বিষয়টি গুরুত্বে আসে যে, সেখানে কিভাবে পরিবেশ, কাসরুম, বইখাতা, যাতায়াত, খাওয়া, স্বাস্থ্য শিক্ষা আরো কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়। অপর পক্ষে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ব্যানারে এই আলোচনায় উন্নয়নশীল/গরীব দেশে শিক্ষার হার, মান, বৈষম্য, স্কুল ভবন, মাঠ, ইত্যাদি নিয়ে খুব কমই কোন কথাই স্থান পায়নি। আমি একইভাবে আমাদের দেশে যেখানে দারিদ্রতার জন্য স্কুলেই যেতে পারে না, সেখানে এই ধনী-গরীব আলোচনার বৈষম্যে মৌলিক অধিকার সুমূহকে প্রাধান্য রেখে বক্তব্য রাখি। অবশ্য অনেক যুক্তি তর্কের পরে, আমার মনে হয়, আমি বুঝাতে পেরেছি যে, মৌলিক অধিকার সুরক্ষাই মানবাধিকার। ফলশ্রুতিতে টরেন্টোর ওম্বাড্সম্যান গং. Ms. Fiona Crean উপলদ্ধিকে গ্রহণ করে আমাকে একটি চিঠিও দিয়েছেন।
আজকের এই মানবাধিকার দিবসে আরো গহীনে গিয়ে বলা যায় যে, মানবাধিকার প্রতিটি লোকের পরিবারের, সমাজের, এমনকি অঞ্চলের কৃষ্টি, পরিবেশ, কালচার, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অচার বিচার ইত্যাদি সবকিছুকেই উঁচিয়ে রাখা- সমৃদ্ধশালী করাসহ সংগ্রক্ষণই নয় একে এগিয়ে নেয়ার অধিকার আদায় প্রাপ্তি অনুশীলই মানবাধিকার। এ সকল মানবাধিকার রক্ষার বিষয়গুলোর সাথে ‘নোয়াখালী বিভাগ’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও মানবাধিকার রক্ষারই গতিপ্রবাহ। দেশের অন্যান্য এলাকার সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন অধিকার রক্ষার জন্য অবশ্যই স্ব-স্ব এলাকাই দ্বায়িত্ববান। জেলে, কৃষক, আধিবাসী, তাতী, নৃগোষ্টি, চর বাসী, নদী ভাঙ্গায় আক্রান্ত, স্ব-স্ব ধর্ম, প্রজনন ক্ষমতা, নারী শিশু, জলবায়ু, সীমান্ত রক্ষা ইত্যাদির জন্য এ ভাবেই আঞ্চলিক ও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকারের স্বাধীনতা প্রস্ফুটিত হয়। মানবাধিকার পূরণের শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ রচনা হয়।
এ বছরের মানবাধিকারের স্বাধীতার প্রতিপাদ্যের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশে পৌরসভা নির্বাচনে (৩০ ডিসেম্বর ২০১৫) সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের জন্য নিবাচনী প্রতীক রাখা হয়েছে- চুড়ি, চকলেট, পুতুল, ফ্রগ, কাঁচি, ভ্যানিটিব্যাগ, হারমোনিয়াম, মৌমাছি, আঙ্গুর, গ্যাসের চুলা। যা স্পষ্টতই নির্বাচনের প্রতীকের ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের প্রতীক বলে কোন বিশেষ ব্যাপার থাকতে পারে না। তা ছাড়া এতে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য সৃষ্টি হয় এবং এটি সংবিধান গ্রহণ করে না। এটাও মানবাধিকারের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে লিঙ্গ বৈষম্য মুক্ত করতেই হবে। তাহলেই ‘ভোটের অধিকার, মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠার পথ পাবে।
অন্য ভাবে যদি বলা যায়, দারিদ্রের মূল কারণ বৈষম্য। বন্টন ব্যবস্থা সুষম হলে বৈষম্য থাকবেনা। মানবাধিকার Violation‘র পণ্য হলো দারিদ্র। বর্তমান ক্ষমতা কাঠামো বৈষম্যকে সমর্থন করে ও এর পক্ষে কাজ করে। ক্ষমতায় আসীনদের ক্ষমতা পাকা পোক্ত করার জন্য ক্ষমতা কাঠামো দূর্নীতিকে লালন পালন করে। তাই বক্তৃতায় মুখের বুলিতে বৈষম্যদূর করণের কথা বল্লেও কার্যত বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসা যাচ্ছে না। এ এক বিরাট খপ্পর। একে জোরে ধাক্কা না দিলে এই দেয়াল ভাঙ্গা যাবেনা, ভাঙ্গবেনা। এই বৈষম্যের সমাজ ভাঙ্গতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে। বৈষম্য দূরীকরনে জোড় আওয়াজ তুলতে হবে। মানবাধিকার রক্ষা আন্দোলনে সোচ্চার হতে হবে। ২০১১ জাতিসংঘ ঘোষিত শ্লোগান ছিল- সকলের জন্য মর্যাদা ও ন্যায্যতা (Dignity and Justice for All). এবার চার বছরে পরে এসে প্রশ্ন করা যায়, আমরা কতটুকু পেলাম?
বৈষম্য দূর করতে হবে। সু-শাসন স্থাপন করতে হবে। একটি রাস্ট্রের সু-শাসনের সূচক/ মানদন্ডের ব্যাপারে ইতোমধ্যে একটি বৈশ্বিক ঐকমত্য তৈরী হয়েছে। সে মতে সুশাসনের সূচক/মানদন্ডগুলি হলোঃ ১. জবাবদিহিতা ২.স্বচ্ছতা ৩. অংশগ্রহন ৪.আইনের শাসন ৫.দায়িত্বশীলতা ৬. কার্যকারিতা এবং পারংগমতা ৭.স্বাধীনতা, অধিকার ও সমতা ৮. ঐকমত্য ৯. কৌশলগত রুপকল্প।
এই ৯টি সূচকের প্রতিটির সঙ্গে প্রতিটি সংশ্লিষ্ট বা সম্পৃক্ত। একটি ছাড়া অন্যটি অকার্য্যকর ও সার্বিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠাা ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হয়। আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা দলিলেও ন্যায্যতা ও সমতার কথা বলা আছে। ন্যায্যতা সমতা সৃষ্টি হলেই মর্যাদা স্থাপিত হয়। অতএব অধিকার রক্ষায় সমতা আনয়নের যেমন বিকল্প নাই, তেমনি বড়-ছোট, গরীব-ধনী সকলের অংশগ্রহন ও ঐকমত্য ছাড়া বৈষম্য বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য সর্বশেষ ৯ম মানদন্ড কৌশলগত রুপকল্পও তৈরী করতে হবে। স্বল্প, মাঝারী ও দীর্ঘ মেয়াদী কৌশলগত রুপকল্প ও তা আন্তর্জাতিকভাবে Unitedly গ্রহণ ও সমর্থন করে রাস্ট্রিয় ভাবে বাস্তবায়নের বিকল্প নাই। দেশে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীভুক্ত সকল কর্মসূচীকে সমন্বিত করে আশু সমাধান ও চলমান উন্নয়ন প্রক্রীয়া হিসাবে এগিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি পরিধিও বাড়াতে হবে।
একই সঙ্গে বৈষম্য দূরীকরনে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী হিসাবে মা কেন্দ্রিক মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ ৬টি অধিকার সূচকসমূহ বাস্তবায়ন কার্য্যকারিতায় আনতে হবে। ৬টি সূচক হলো ১. মাতৃত্বকালীন ভাতা, ২. স্বাস্থ্য, পুষ্টি জন্ম নিয়ন্ত্রন কার্ড ৩. শিক্ষা ও বিনোদন কার্ড ৪. গৃহ ও পয়ঃ নিষ্কাসনসহ নিরাপদ পরিবেশ ৫. জীবিকায়ন উন্নয়ন থোক তহবিল ও ৬. কর্মসংস্থানে উন্নয়ন ক্ষুদ্রঋণ। বিশ্ব ও সরকারকে এই ৬টি বিষয় বিনিয়োগও সমর্থন দিতে হবে। তাহলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তা জাল সৃস্টি ও অধিকার বাস্তবায়নের পথ রচনা করা যাবে। যাতে পৃথিবীতেও ও দেশে আর গরীব না জন্মে বা সৃষ্টি না হয়।
সমগ্র বাংলাদেশে এটি বাস্তবায়নে প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা করে মোট ২০ বছরে ১লক্ষ কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা বিনিয়োগ খাতে বাজেট বরাদ্দ রাখতে সরকারের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। নতুবা প্রতিবছর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে এ ধরনের সুন্দর সুন্দর ডাক আসতে থাকবে, আনুষ্ঠানিকতা চলতেই থাকবে। শোষিত নীপিড়িত, বঞ্চিতরা বৈষম্যের খপ্পরে এ আটকেই থাকবে, বেরিয়ে আসার শুধু হাতছানিই থাকবে, মুক্তির পথ আসবেনা। তাই দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য এখনই সময় ২০ বছর এক প্রজন্ম মেয়াদে, ‘প্রজন্ম প্রতিভা বিনির্মানে’ ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ রুপকল্প বাস্তবায়ন করার সময়। তাহলেই বৈষম্য দূরীকরণের কথায় সোচ্চার থেকে মর্যাদা বাস্তবায়ন রুপ লাভ করবে এবং ন্যায্যতা, মানবাধিকার ও সাম্যতা স্থাপিত হবে।
এএইচএম নোমান : সভাপতি- বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদ-বামাসপ ও গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী । ই-মেইল cchrbdhaka@gmail.com