।।[ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে যে স্বাধীনতা, আমরা পেয়েছি যে বিজয়… সেই বিজয় অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো এদেশেরই কিছু মানুষরূপী নরপশু। বিজয়ের ৪৪ বছরে সেই নরপশুদের বিচার হচ্ছে। সত্যি অন্যরকম সাধ, অভিপ্রায় – যে রাষ্ট্রনামক যন্ত্রটি তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বিজয়ের উল্লাসের মধ্য দিয়ে অত্রিক্রম করছে। লাল-সবুজের মানচিত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কারো কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। কারণ, লাখো শহীদের রক্তে আর মা বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে কেনা আমাদের মাতৃভূমি।]।।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাব ও স্বৈর দৃষ্টিভঙ্গীর বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ ছিল মজলুম নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৯ সালে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নিবার্চনে বিজয় এবং ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খানকে পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল বা ‘কপ’- প্রতিষ্ঠা ছিল পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বমূলক আন্দোলনের মাইলফলক। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের প্রশ্ন ১৯৫০-এর মধ্যভাগ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে।
১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধারণাটি স্পষ্ট হতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় দায়ের করা হয়। ১৯৬৯-এ আয়ুব খানের পতন হয়, তবে সামরিক শাসন অব্যাহত থাকে। সামরিক সরকারের অধীনে ১৯৭০-এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর থেকে বিরত থাকেন।
পূর্ব পাকিস্তান (১৯৪৭-১৯৭১) ছিল পাকিস্তানের পূর্ব অঙ্গ যা ১৯৭১-এ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, ভারত ও পাকিস্তান। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই সময়কে পাকিস্তান আমল হিসাবে উল্লেখ করে থাকে। মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয়, যার ফলে মানচিত্রে দুটি পৃথক অঞ্চল গড়ে ওঠে। যার একটি পূর্ব পাকিস্তান (তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশ) এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংঘাতের প্রথম লক্ষণ হিসাবে প্রকাশ পায়। পরবর্তী দশক জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে নানা পদক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মনে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। এর মধ্যে চড়াই, উৎরাই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে মায়ের ভাষার লড়াই গুরুত্ব পায়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক নতুন সূর্য উদিত হয় ১৯৫২’র মহান ২১ ফেব্রুয়ারির।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা অর্থনৈতিক শোষনের শিকার হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তৎকালীন মুসলীম লীগ সরকারের উপর। তার প্রতিফলন ঘটে ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারর্দীর নেতৃত্বে গঠিত মোর্চা যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা কর্মসূচী-র ভিত্তিতে নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে সরকার গঠন করে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে। স্বায়ত্বশাসন থেকে বঞ্চিত করা হয় পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের জনগনকে।
১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ছয় দফার দাবির মূল উদ্দেশ্য – পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল বা যৌথরাষ্ট্র এবং ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই ফেডারেশন বা যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ন স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। পরবর্তীতে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়।
এই আন্দোলনকে স্থিমিত করার উদ্দেশ্যে সরকার মে মাসে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। এবং পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো কিছু বাঙালি সেনা, নৌবাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনের পদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে একটি ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। এই মামলার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল রূপ ধারন করে। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচী পেশ করেন। কিন্তু তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান এই দাবি অগ্রাহ্য করে আন্দোলনকারীদের উপর দমনপীড়ন শুরু করেন। এই আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনায় প্রাণ হারান ছাত্রনেতা আসাদ, কিশোর মতিউর, সার্জেন্ট জহুরুল হক, শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা সহ আরো অনেকে। এই সকল ঘটনায় সরকারের উপর চাপ বৃদ্ধি পেলে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অবশেষে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং ২৪ মার্চ তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলে বিক্ষোভের অবসান হয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদের নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের ৫টি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। উভয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের সর্বমোট ৩০০ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসন অধিকার করে। অন্যদিকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮ আসন অধিকার করে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা লাভ করে।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চের আগে ঢাকা থেকে সব বিদেশি সাংবাদিককে বের করে দেয়া হয়। সে রাতেই পাকিস্তান বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামের হত্যাযজ্ঞ। যদিও এই হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা, পুরো দেশজুড়ে বাঙ্গালী হত্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ লক্ষ্য। মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর পাকিস্তানী হায়েনার দল লোমহর্ষক বর্বরতা চালায় । একমাত্র হিন্দু আবাসিক হল-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়।
মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ পুরো বাংলাদেশেই হিন্দু এলাকাগুলো বিশেষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মধ্যরাতের আগেই, ঢাকা পুরোপুরি জ্বলছিল, বিশেষভাবে পূর্ব দিকের হিন্দু প্রধান এলাকাগুলো। ২ আগস্ট, ১৯৭১ টাইম সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু, যারা মোট রিফিউজিদের তিন চতুর্থাংশ, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ক্রোধ ও আক্রোশ বহন করছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। গ্রেফতার হবার একটু আগে শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। শেখ মুজিব গ্রেফতার হবার পূর্বে ২৫মার্চ রাত ১২টার পর (অর্থাৎ ২৬মার্চ) টি.এন্ড.টি ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ই.পি.আর) ওয়ারলেসের মাধ্যমে মেসেজে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫শ খন্ড,পৃ:৫৬)।
২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞে আওয়ামী লীগের অনেক প্রধান নেতা ভারতে আশ্রয় নেয়। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কয়েকজন কর্মকর্তা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ.হান্নান প্রথম শেখ মুজিব এর স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি মাইকিং করে প্রচার করেন। পরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এক বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র পাঠ করেন। (সূত্র : মেজর জিয়ার বেতার ঘোষনা এবং বেলাল মাহমুদের সাক্ষাৎকার)
এই সময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন কর্ণেল অলি আহমেদ (তৎকালীন ক্যাপ্টেন)। সরাসরি সেনাবাহিনীর থেকে আহবান পাওয়ার পর সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে এবং দেশের মানুষ নিশ্চিত হয় যে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আর এর প্রেক্ষাপটে কয়েক লাখ বাঙ্গালী আপামর জনতার রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়।
আখতার-উজ-জামান
azamansun@yahoo.com