মো. শহীদ উল্লা খন্দকার
মেধাবী সন্তানরা দেশের সম্পদ। একটি দেশ এগিয়ে যাওয়ার মূলশক্তিই হচ্ছেন এই মেধাবীরা। এদেশের এমনই একজন মেধাবী বিজ্ঞানীর নাম ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া। তিনি আমাদের গর্বের পরমাণুুবিজ্ঞানী। বাংলাদেশের আণবিক পাওয়ার প্লান্টের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তার বিজ্ঞান সাধনার উতকর্ষতার জন্য তিনি যুগের পর যুগ বাংলাদেশের ইতিহাসে নক্ষত্র হয়ে জ্বলবেন।
ক্ষণজন্মা এই মহান মানুষটির জন্মদিন আজ। ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুরের পীরগঞ্জের নিভৃত গ্রাম ফতেপুরে তাঁর জন্ম। ডাক নাম সুধা মিয়া। যাঁর অপরিসীম জ্ঞান ও আন্তরিকতায় আলোকিত হয়েছে আমাদের দেশ। তিনি পরমাণু বিজ্ঞানকে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
তাঁর বিজ্ঞানচর্চার পরিধি কতটা সুউচ্চ ছিল তা আমাদের অনেকেরই অজানা।
১৯৬৯ সালে ইতালির ট্রিয়েস্টের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র তাঁকে এসোসিয়েটশিপ প্রদান করে। এই সুবাদে তিনি ১৯৬৯-’৭৩ ও ১৯৮৩ সালে ওই গবেষণা কেন্দ্রে প্রতিবার ৬ মাস ধরে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন শহরের ড্যারেসবেরি নিউকিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট ডক্টোরাল গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ থেকে ২৪ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ততকালীন পশ্চিম জার্মানির কার্লসরুয়ে শহরের ‘আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে’ আণবিক রিঅ্যাক্টর বিজ্ঞানে উচ্চতর প্রশিণ লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি ভারতের আণবিক শক্তি কমিশনের দিল্লির ল্যাবরেটরিতে গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
তাঁর যোগ্যতার মাপকাঠি ছিল প্রশ্নাতীত। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে তিনি পরপর দুবার বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে তিনি পরপর তিনবার ওই বিজ্ঞানী সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চার বছর তিনি বাংলাদেশ পদার্থ বিজ্ঞান সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৯৭ এবং ১৯৮৯ সালে দুবছর মেয়াদের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। আর এসব পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন শুধুমাত্র তার যোগ্যতার নিরিখেই।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর দুবার বাংলাদেশ বিজ্ঞান উন্নয়ন সমিতির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি পরপর দুবার দুবছর মেয়াদকালের জন্য ওই বিজ্ঞান সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১-১৯৯২ সালে তিনি বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘেরও সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার তিনি ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানজীবী সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন।
আজ বাস্তবায়নের পথে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্প। বলা যায়, এটা অনেক বড় এক স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের এই পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পূরণ হবে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। সফল হবে বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার আমরণ প্রচেষ্টা এবং সুফল ভোগ করবে সারা দেশের মানুষ।’ যথার্থই বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
ড. ওয়াজেদ মিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা চিনতেন, কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা একবাক্যেই বলেছেন, তাঁর মতো সত, নির্লোভ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। যেখানে একজনের মতাকে ব্যবহার করে দুর্নীতি আর দুঃশাসনের উন্মত্ততায় মেতে ওঠে তাঁর চারপাশের লোকেরা, সেই প্রোপটে তাঁকে মূল্যায়ন করার মতো কোন মাপকাঠি আমাদের জানা নেই।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আদর্শের জন্য প্রতিনিয়ত অকান্ত পরিশ্রম করেছেন। সহকর্মীদেরও উদ্বুদ্ধ করেছেন সত ও ন্যায়-নিষ্ঠাবান হওয়ার জন্য। তিনি নিজে মতার খুব কাছাকাছি থেকেও কোন সুযোগ-সুবিধা নেননি। কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। সর্বদা নিজস্ব বলয়ে থেকে নিজের যোগ্যতায় নিজ কর্মেেত্রর পরিধিতে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কর্মজীবন শেষ করেছেন।
তিনি শুধু একজন মেধাবী ছাত্র বা পরমাণুবিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি ছিলেন নির্লোভ, নিভৃতচারী, নীতিবান, নিরহংকার, নির্ভীক, স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা, দেশপ্রেমিক, আদর্শবান, সত, সহজ-সরল, বিনয়ী, চরিত্রবান, যুক্তিবাদী, অজাতশত্রু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষ। এত গুণে গুণান্বিত মানুষ ক’জন আছেন এই ভূবণে।
রংপুরের পিছিয়ে পড়া এক গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন কেবল শিার মাধ্যমে। পীরগঞ্জের ফতেপুরের সাদাসিধে ছেলেটিই বড় হয়ে দেশের অন্যতম একজন আনবিক বিজ্ঞাণী হিসেবে নাম কুড়ালো। আরো অবাক করা ব্যাপার সে বড় হয়ে হলো জাতির জনকের জামাতা। সবই হলো তার লেখাপড়ার গুণে, মেধার গুণে।
সহজ, সরল, মেধাবী, সদা সত্যভাষী এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় অনন্য এই মানুষটিকে কন্যা শেখ হাসিনার স্বামী হিসাবে পছন্দ করেন বঙ্গবন্ধু। ওয়াজেদ মিয়া-শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আইটির উন্নয়নে এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই স্বপরিচয়ে খ্যাত।
ড. ওয়াজেদ মিয়া সাতটি পাঠ্যবই লিখেছিলেন, এরমধ্যে ছয়টিই ইতোমধ্যে প্রকাশিত। মৃত্যুর আগে সপ্তম বইটির সম্পাদনার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।
ব্যক্তিজীবনে মতার ভিতর থেকেও কখনও মতার অপব্যবহারের সামান্যতম সুযোগ নেননি। যা তাঁর জন্য খুব সহজ ছিলো। তিনি আপন অবস্থানে থেকেই কাজ করে গেছেন। তার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশের রূপপুরে একটি পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র চালু করা, দেশের বিজ্ঞানীদের পেশাগত কাজের উতকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ করা। দেশের বিজ্ঞান ভিত্তিক শিা ও গবেষণা প্রসারে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
ড. ওয়াজেদ মিয়া মনে করতেন, সমাজে বিজ্ঞানীদের যথাযথ অবস্থান নিশ্চিত করতে হলে বিজ্ঞানীদের আগে নিজেদের কাজ করে যেতে হবে তারপরই কেবল জনগণের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা যেতে পারে।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া পান্ডিত্য ও প্রতিভার দ্বারা নিজস্ব একটি পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্যই অন্য পরিচয়গুলো তাঁর জন্য অলংকার। যেসব কথা তিনি প্রচার করতে চাননি, তার প্রয়োজনও বোধ করেননি। মৃত্যুর আগে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া সম্পর্কে দেশবাসি যতটা জানতেন, মৃত্যুর পর জেনেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি।
লেখক : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিব