ভাষা সৈনিক নুরু মোল্লা

দেলওয়ার হাসান ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের পর পেরিয়ে গেছে ৬১ বছর। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে জাতিসংঘের, প্রত্যেকটি জাতির মাতৃভাষা রক্ষা ও সুপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনুসরণীয় হচ্ছে। এভাবে আমাদের ভাষা আন্দোলন আজ বিশ্ব ভাষা আন্দোলনে রুপ নিয়েছে। এর চেয়ে মহান ও গৌরবময় আন্দোলন হয়ত বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। এ মহান আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হাজী আবু নুর এমডি শামসুল ইসলাম।

তিনি বলেছেন, ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন তথ্য। জানিয়েছেন তার পারিবরিক ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কেও। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধেও। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মী।

হাজি আবু নুর মো: শামসুল ইসলাম (নুরু মোল্লা) ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লক্ষীপুর জেলার সদর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হলেন মরহুম হাজী আমিন উল্লা মোল্লা এবং মাতা হলেন মরহুমা মোছাম্মদ সালেমা খাতুন। তিনি ৬ ছেলের জনক। সন্তানরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত।

শৈশব : ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন খুবই ভদ্র ও চিন্তাশীল। অন্যান্য ছেলে মেয়েদের থেকে ব্যতিক্রম। তার পিতা লক্ষীপুর আদালতে কর্মরত ছিলেন। সেখানেই তিনি মাধ্যমিক স্কুলের লেখাপড়া শেষ করেন। এরপর তিনি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।

ছাত্র রাজনীতি ও ভাষা আন্দোলন : জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ব বিদ্যালয়) ১৯৫০ সালে ছিল ভাষা আন্দোলনে উত্তাল। তিনি আগেই ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। জগন্নাথ কলেজে ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক পদ লাভ করেন। এ শাখা সভাপতি ছিলেন আব্দুল মোমিন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মো: শাহজাহান। বাংলাভাষা রক্ষায় গঠিত সর্বদলীয় সেন্ট্রাল কমিটি অব এ্যাকশনের মেম্বার মনোনীত হন হাজী আবু নুর মো: শামসুল ইসলাম (নুরু মোল্লা)। এ কমিটিতে হেদায়েত, মনি সিং, অলি আহাদ, তোহা প্রমুখ নেতা সহ অনেক নেতা-কর্মী ছিলেন। তখন এ এ্যাকশন কমিটি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, টিনের চোঙ্গা দিয়ে রাস্তায় মোড়ে মোড়ে বক্তব্য এবং শ্লোগান দিত। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই ইত্যাদি শ্লোগান ছিল অন্যতম।

এ আন্দোলনের মুখে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে পাক সরকার। ওইদিন জগন্নাথ হলের এসেম্বলিতে নুরুল আমীনের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। এক্ষেত্রে এ্যাকশন কমিটি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং কলেজের ভিতরে আমতলায় জমায়েত ও মিছিল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে তোহা সাহেবের বাসায়। সেখানে গাজিউল হকসহ এ্যাকশন কমিটির সব নেতাই উপস্থিত ছিলেন।

এ সভায় আবু নূর মো: শামসুল ইসলাম (নুরু মোল্লা) দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা  করেছিলেন  আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবই। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমতলায় তারা সমবেত হন। একটি ভাঙা টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে গাজিউল হক বক্তব্য শুরু করেন। তাদের ঘেরাও করে আছে ইপিআর বাহিনীর সিনিয়র সদস্যরা। এর নেতৃত্বে ছিলেন এসপি মাসুদ (পাকিস্তানি) এবং বাঙালী ডিএসপি কাদের। হঠাৎ তারা হানা দেয় নেতৃবৃন্দের অনেককেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায় ইপিআর ভ্যানে করে। সে অনুষ্ঠান থেকে অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আবু নুরও ছিলেন। তারা গ্রেফতার এড়িয়ে মেডিকেল কলেজের তৎকালীন মলির বেড়া ভিঙিয়ে গিয়ে আবার মিছিল শুরু করেন। এ মিছিলে পাক সেনারা নির্বিচারে গুলি চালায় এবং তাতে ৬-৭ জন শহীদ হন। আহত হন অনেকে। আবু নুর এর ডাক নাম ছিল নুরু। তিনি বন্ধুদের নিয়ে একটি মৃত দেহ লুকিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ওই লাশ নিয়ে পুনরায় মিছিল শুরু হলে সেই মিছিলেও নির্বিচারে গুলি চালানো হয় এবং সেদিনও সেখানে ২ জন শহীদ হন। এ মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছিল কার্জন হলের সামনে। এ ঘটনার পর আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ্যাকশন কমিটির পক্ষে নুরু মোল্লা এবং ডাঃ আব্দুস সাত্তার ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম যান এবং লাল দীঘি ময়দানে সমাবেশ করেন। তারা ২৫ ফেব্রুয়ারি সমাবেশ করেন চৌমুহনী কলেজের সামনে। এভাবে ছাত্রলীগ ও এ্যাকশন কমিটি সারা দেশে দুর্বার ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলে এবং পাক সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দেয়।

সারাদেশের মানুষ একযোগে ভাষা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে ও বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সেদিন বাংলা ভাষাকে পাক সরকারের ছোবল থেকে রক্ষা করে এবং এ সফল ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় আসে ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ : ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে পাক হানাদাররা বাঙালেিদর উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করার পর আব্দুল মালেক উকিলসহ নুরু ভারতে চলে যান এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে এসে পাকসেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। তখন তিনি ছিলেন তরুণ আওয়ামীলীগ নেতা। এ অবস্থায় তিনি লক্ষীপুর, রামগঞ্জ, পুদ্দার হাট, কাজী দিঘী মীরপাড়া প্রভৃতি এলাকায় পাকহানাদার ও রাজাকারদের সাথে একাধিকবার সম্মুখ সমরে লড়াই করেন। তিনি লক্ষীপুর জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন।

দেশ স্বাধীনের পর : দেশ স্বাধীনের পর তিনি লক্ষীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য এবং ৮ নং রশিদপুর ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাকে লক্ষীপুর-২ আসনে থেকে সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেন। পরবর্তীতে রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের বিশেষ অনুরোধে তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যান এবং তার নিজের পরিবর্তে লক্ষীপুর জেলা মুক্তিবাহিনীর প্রধান বেলায়েত হোসেনকে উক্ত আসনে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বর্তমানে তিনি লক্ষীপুর জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুবই কাছের মানুষ ছিলেন।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

hasandelower@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts