বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবে কতদূর?

মোতাহার হোসেন

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন এবং এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্যোদয়ের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দৃঢ় হাতে হাল ধরে তিনি নৌকা ভাসিয়েছিলেন স্বপ্ন পূরণের পথে,এই পথযাত্রায় তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন পুরো বাঙ্গালীকে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণে ওত পেতে একাত্তুরের পরাজিত শকুনেরা সুযোগ বুঝে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেয় জাতির জনকের বুক, ছিন্নভিন্ন করে দেয় সেই স্বপ্নের মানচিত্র। তারপর দশকের পর দশক ধরে চলে অন্ধকারের রাজত্ব। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন সত্যি হতে চলছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন  ক্ষেত্রে ৪৫ বছর আগের সমৃদ্ধ পাকিস্তানকেও পেছনে ফেলে এগিয়েছে বাংলাদেশ।

 

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতোপূর্বে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পসহ বহুমুখী উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ২০২১ সালে  মধ্যম আয়ের আর ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ।

 

সরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পর্কে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নে বড় সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমছে দ্রুত হারে, বাড়ছে মাথাপিছু আয়। ৭ শতাংশের ঊর্ধ্বে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৭৫ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করা দেশ এখন শুধু একটি প্রকল্পেই ব্যয় করছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এটি রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। দেশের এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অন্য দেশগুলোর সামনে বাংলাদেশের উদাহরণ তুলে ধরে তা অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছে। এসব দেখে তারাই বলছেন,বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।

 

সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রমিক, কৃষক সর্বস্তরে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতার উন্নতি ঘটছে। এর মধ্য দিয়েই প্রত্যাশিত সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা বলতে এমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, যেখানে থাকবে না দারিদ্র্য, থাকবে না বঞ্চনা, শোষণ। অগ্রসরমান একটি দেশ হিসেবে অভ্যুদয় ঘটবে বাংলাদেশের। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর হাতেই প্রণীত হয় বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা; যেখানে কৃষি, গ্রামীণ অবকাঠামো ও কুটির শিল্প উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকারি অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই স্বপ্ন সামনে রেখে বর্তমানে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের কাজ করছে সরকার।

 

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যেই উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সরকার নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। বিনামূল্যে প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বছরের প্রথম দিনই বই তুলে দেয়ার নজির বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশেই প্রথম। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বৃত্তি,প্রাথমিক স্কুলে ‘মিডডে মিল্ক’চালু বিশ্বে অনন্য নজির। এতে শিক্ষায় ঝরে পড়া হ্রাসসহ শিক্ষার হার বাড়ছে।

 

দৃশ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা সূচকের অগ্রগতির সঙ্গে রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা, বেকারত্ব দূর করা, দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলা এবং বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

 

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসে। তারপর ২০০৯ সালে আবার বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ২০১৪ সালেও পুননির্বাচিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা ও গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। টানা আট বছর সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে দেশের চিত্র বদলে যাচ্ছে। প্রতিবেশীসহ অনেক দেশের তুলনায় সামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে ইতোমধ্যেই উন্নীত হয়েছে।

 

শিক্ষার প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়ন,খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ক্রমাগত সম্প্রসারণ, দারিদ্র্যের হারহ্রাস,নারী ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস,স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন,বিদ্যুৎ,জ্বালানী খাতের উন্নয়ন,যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। আট বছরে বাজেটের আকার ৯৪ হাজার কোটি টাকা থেকে তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এই সময় ধরে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। রপ্তানি বেড়েছে বছরে ১০ শতাংশেরও বেশি হারে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ঊর্ধ্বে নিতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে কাজ চলছে।

 
গত ১০ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র আট বছরের মাথায় বর্তমানে দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে।

 

এক দশক আগে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশের বাজেটের আকার ছিল ৬৪ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা, যা এখন তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকায় উঠেছে। সে সময় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা এখন এক লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণে বড় সাফল্য রাখা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। ১০ বছরে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছয় গুণেরও বেশি বেড়েছে।

 

গত ১০ বছরে মোট রপ্তানির পরিমাণ ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে গত অর্থবছর শেষে ৩৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমদানির পরিমাণ ১৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মোট প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত অর্থবছর শেষে ১৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

 

বাংলাদেশের এই অগ্রগতিতে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শি ,সাহসী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামনে থেকে পথ দেখাচ্ছেন স্বপ্নের সোনার বাংলাকে সত্যি কারের সোনার বাংলায় রুপান্তর করতে। অচিরেই দৃশ্যমান হবে সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা। এট সত্যি যে, ‘একটা দেশ ততখানিই এগোয়, যতখানি রাজনৈতিকভাবে আগায়। বাংলাদেশে যেটুকু অর্জন, তা রাজনীতির। বর্তমান সরকার বিভিন্ন নীতির মাধ্যমে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে নির্দেশনা দেন, সরকারি কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়ন করেন।

 

একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’-এর মধ্যে শুধু রাজনৈতিক মুক্তির বিষয়টি ছিল না, দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। এত অল্প সময়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, গ্রামের মানুষের হাতেও অর্থ আছে। শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দিনে ৮০০ কোটি টাকা শহর থেকে যাচ্ছে গ্রামে। শিল্প খাতে বড় ধরনের উন্নয়ন ঘটছে। বাংলাদেশ এখন সবুজ উন্নয়নের দিকে ঝুঁকছে। পদ্মা সেতু, রুপপুর পারমাণবিকবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণসহ ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

 

‘আমার সোনার বাংলা’ কবিতায় ‘সোনার বাংলা’ বলতে পাকা ধানের সোনালি রংকে বুঝিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের সমৃদ্ধির কথা তুলে ধরা হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা বলতে ‘কমপ্লিট বাংলাদেশ’কে বুঝিয়েছেন। তিনি সুখী, সমৃদ্ধ, বৈষম্যহীন পরিপূর্ণ বাংলাদেশ চেয়েছেন। এখন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা সেই অসমাপ্ত স্বপ্ন সোনার বাংলা সত্যিকারের রুপ দিতে কাজ করছেন নিরন্তর।

 

বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, গত ৪৫ বছরের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে তার আংশিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক দুর্বলতা রয়েছে। এসব দুর্বলতা সামাজিক অবয় ডেকে আনে, মূল্যবোধ নষ্ট করে দেয়। এটি অর্থনৈতিক ভাবে একটি দেশকে পিছিয়ে দেয়। ‘সোনার বাংলা’ মানে উন্নত বাংলাদেশ। দুর্নীতি রোধ ও প্রাতিষ্ঠানিক সমতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তা ছাড়া উন্নত দেশ গড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো দেশের বিপুল শ্রমশক্তিকে দ করে গড়ে তোলা। এটা করা গেলে দেশের অগ্রগতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এ জন্য শেখ হাসিনার নের্তৃত্বাধীন সরকারের ধারাবাহিকতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য্য। আর এ জন্য প্রয়োজন প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখা।

 

মোতাহার হোসেন :সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।

motaherbd123@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts