৭ই মার্চের নির্দেশ বুকে ধারণ করেই বাংলাদেশ

মাসুদুল হাসান

image001

১৯৭১এর ৭ই মার্চের বসন্তে জাতির হৃদয় জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়েছিল, উত্তাল হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ চূড়ান্তভাবে একটি জাতিকে মুক্তির লড়াইয়ে নামিয়ে দেওয়ার দিন। যেখান থেকে আর পেছনে চলে যাওয়ার কোন পথ নেই। রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মঞ্চ ঘিরে সেদিন সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী জনতা এক স্রোতে এসে মিশেছিল। সেদিন ছিল রবিবার। সকাল থেকেই সারাদেশের জনস্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে।

মূলতঃ ৭ মার্চ স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার চূড়ান্ত আহবান। ১৯৭১এর ৭ই মার্চ, এমন একটি দিনের জন্যই বঙ্গবন্ধু নিজকে, আওয়ামী লীগকে সুদীর্ঘ ২৩টি বছর ধরে প্রস্তুত করেছিলেন এবং বাঙালী জাতিকে উন্নীত করেছিলেন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবেন বাঙালীর মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভাষণে তিনি কী বলবেন? তার বর্জকন্ঠে কি উচ্চারিত হবে? দেশজুড়ে সকলেরই মনে তখন এই একটিই জল্পনা-কল্পনা।

স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের ঢলে একাত্তরের এদিন রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে রীতিমত জনবিস্ফোরণ ঘটে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ক্ষমতা হারায় সেদিনের রেসকোর্স।

একাত্তরের ১ মার্চই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী ৭ মার্চ ঘোষণা করা হবে। কার্যত, সারা দেশের মানুষ সেদিন থেকেই অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরবর্তী দিকনির্দেশনা জানার।
গণমানুষের স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে জনসমুদ্রের মঞ্চে আসেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। ফাগুনের সূর্য তখনও মাথার ওপর। আকাশ কাঁপিয়ে স্লোগান হচ্ছে, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।

বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতকাটা কালো কোট পরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রাণপুরুষ দৃপ্তপায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। দাঁড়ালেন মাইকের সামনে। আকাশ কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশে। তারপর শুরু করলেন ভাষণ।

মঞ্চে দাঁড়িয়েই বিশাল জনসমুদ্রে পাকিস্তানের নিষ্পেষণ থেকে বাঙালীর মুক্তির মূলমন্ত্র ঘোষণা করলেন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালী জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। মাত্র ১৯ মিনিটের স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের জানিয়ে দেন, স্বাধীনতাকামী জনতাকে আর বুলেট-বেয়নেটে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

তাই বর্জ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে রেসকোর্সের মাঠে তিনি আবৃত্তি করেন বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে ওঠে মুক্তিপাগল বাঙালীর। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহু স্লোগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝান্ডায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালী রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র।

সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু উদাত্তকণ্ঠে বলেন- ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করো…’। স্বল্পতম সময়ের এই ভাষণের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতিকে তুলে আনেন এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায়।

সেদিন বেতারে সরাসরি বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঐতিহাসিক এই ভাষণটি প্রচারের কথা থাকলেও তা করেনি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীরা। কিন্তু মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিবের নির্দেশ, ‘আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, আদালত, ফৌজদারি আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিক্সা, গরুরগাড়ি, রেল চলবে। ….সেক্রেটারিয়েট ও সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গবর্নমেন্ট দফতর, ওয়াপদা- কোন কিছুই চলবে না। …আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব…আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।”

তবে পরদিন ৮ মার্চ বীর বাঙালীদের চাপে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি রেডিওতে প্রচারে বাধ্য হয় পাক সামরিক জান্তারা।

এদিকে বঙ্গবন্ধু এদিন তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা যাতে না দেন, তার জন্য মার্কিন সরকার তৎপরতা শুরু করেন। ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে সাক্ষাত করেন। স্বল্প সময়ের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরিষ্কার ভাষায় ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানান। তিনি বলেন- ‘পূর্ববাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’

মার্কিন কূটনীতিকের ভাষা এবং পাক সামরিক বাহিনীদের পরিকল্পনার কথার আঁচ পান বঙ্গবন্ধু। তাই বিচ্ছিন্নতাবাদীর দায় চাপিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে যাতে মার্কিন ও পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীরা বিলম্বিত করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ দেন। সরাসরি না দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন বীর বাঙালীকে।

স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ থেকে ছুটে আসা পিপাসার্ত মানুষের তৃষ্ণা মিটে বঙ্গবন্ধুর মাত্র ১৯ মিনিটের অমর কবিতায়, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে। এই একটি ভাষণেই নিরস্ত্র বাঙালীকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার দিন থেকেই মূলত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার অঙ্কুরোদগম ঘটতে থাকে এ বাংলায়। বাঙালীর নিজের দেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়ার অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে এগুতে থাকে। কেননা, একাত্তরের ৭ মার্চ জাতির জনকের কণ্ঠে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা শোষিত-নির্যাতিত বাঙালী জাতিকে মুক্তির জন্য অস্থির-পাগল করে তুলেছিল।

বঙ্গবন্ধুর অমোঘ মন্ত্রে দীক্ষিত-প্রাণিত হয়ে কঠিন সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে দেশ থেকে হানাদারমুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। শুধুমাত্র অদম্য মনোবলকে সম্বল করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে নিরস্ত্র বাঙালী মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের আধুনিক সমরসজ্জিত, প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন যে, ভাষণে তিনি একদিকে স্বাধীনতার ডাক দিলেন, অন্যদিকে শাসকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করার পাতানো ফাঁদেও পা দিলেন না। ১১০৮টি শব্দ সম্বলিত প্রায় ১৯ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন বাঙালী জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। সে নির্দেশ বুকে ধারণ করেই আজ আমাদের বাংলাদেশ।

মৃত্যুপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুঃসাহসে দীপ্ত মুক্তিকামী বাঙালী একাত্তরের মাত্র ন’মাসে প্রবল পরাক্রমশালী পাক হানাদারদের পরাস্ত করে ছিনিয়ে এনেছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ, দুঃসাহসিকতা আর আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালী অর্জন করল নিজস্ব মানচিত্র, লাল-সবুজের পতাকা।

মাসুদুল হাসান : সহ অর্থ বিষয়ক সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটি।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts