শওকত হোসেন
একটা সময় লাখের বাতি জ্বালানোর প্রচলন ছিল। কেউ লাখপতি হলে বাড়ির সামনে উঁচুতে একটা বাতি বেঁধে দেওয়া হতো। আর তাতেই লোকে বুঝতে পারত, এটা লাখপতির বাড়ি। এই লাখের বাতির কথা কেবল বইতেই পড়েছি। দেখার কোনো সুযোগ হয়নি। দুই সপ্তাহ আগে একটা সংবাদ পড়ে ক্ষীণ একটা আশা জেগেছিল লাখের বাতি দেখার। চীনের একটি সংস্থা খবর দিল যে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় বাংলাদেশের একজনের নাম আছে। আর তিনি হলেন সালমান এফ রহমান। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। আবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টাও তিনি।
এমনিতেই আমাদের সাফল্যের খবর খুব কম। চারদিকে অসংখ্য খারাপ খবর। ব্যক্তিগত অর্জনও তেমন নেই। উদ্যাপন করার মতো ঘটনা এখন তো ক্রিকেট ছাড়া আর তেমন কিছুতে নেই। সেখানে সালমান এফ রহমানের বিরল কৃতিত্বের ওই খবর তীব্র গরমে একপশলা বৃষ্টির মতোই। কিন্তু শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মতোই হতাশ হতে হলো আমাদের। দ্রুতগতিতে তিনি প্রতিবাদ করে জানিয়ে বললেন, এত অর্থ তাঁর নেই।
চীনের প্রতিষ্ঠান হুরুনডটনেটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান ১৩০ কোটি ডলারের মালিক। প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসাবে এ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তালিকা অনুযায়ী, ডলারের হিসাবে বিশ্বে বর্তমানে ২ হাজার ২৫৭ জন বিলিয়নিয়ার (১০০ কোটি ডলারের মালিক) রয়েছেন। তাঁদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৮ লাখ কোটি ডলার, যা বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশি ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের অবস্থান ১ হাজার ৬৮৫তম। তালিকা অনুযায়ী শীর্ষ ধনী বিল গেটস।
সালমান এফ রহমান তাঁর প্রতিবাদলিপিতে বলেছেন, ‘চীনা প্রতিষ্ঠান হুরুন গ্লোবাল বলেছে, আমার সম্পদের পরিমাণ ১৩০ কোটি ডলার। প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে এ সম্পদের হিসাব করেছে, তা আমার জানা নেই। সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেক্সিমকো গ্রুপের নিট সম্পদের পরিমাণ এর কাছাকাছি হতে পারে। আমার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ এটা নয়।’ দেখা যাচ্ছে, সালমান এফ রহমান কেবল নিজের কোম্পানির প্রচারই করলেন।
সালমান এফ রহমান কেন অস্বীকার করলেন? ইংরেজিতে ‘মানিগিল্ট’ বলে একটা কথা আছে। সাধারণত, কিছু না করেই উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ যাঁরা পান, তাঁদের মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ দেখা দেয়। একেই বলে মানিগিল্ট। তবে শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অর্থ নিয়ে কারসাজি বা ব্যাংকঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে যাঁরা বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যান, তাঁদের মধ্যে মানিগিল্ট কাজ করে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। এই মানিগিল্ট নিয়ে কিন্তু মজার মজার অনেক গল্প আছে। পরিবেশটা হালকা করার জন্য ছোট্ট একটা গল্প বলি। এক ধনী ব্যক্তির ছোট ছেলে স্কুলের শিক্ষাসফর থেকে বাবাকে এক বার্তা পাঠাল, ‘বাবা, আমি দামি পোরশে গাড়িতে করে যাচ্ছি, আর আমার বন্ধুরা সবাই ট্রেনে যাচ্ছে। এটা দেখে আমার অপরাধবোধ হচ্ছে, খারাপ লাগছে।’ বাবা দ্রুত জবাব পাঠালেন, ‘এক্ষুনি ২০ মিলিয়ন ডলার পাঠাচ্ছি, একটা ট্রেন কিনে নাও।’
হুরুনডটনেট ছাড়াও বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকা তৈরি ও প্রকাশ করার জন্য অনেক সংস্থা আছে। তারা নিয়মিতভাবে তালিকা প্রকাশ করে থাকে। বছরজুড়ে শীর্ষ ধনীদের নানা ধরনের খবর প্রকাশিত হয়। তাঁদের শখ, তাঁদের দান, সম্পদ ওঠানামাসহ নানা ধরনের তথ্য আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে পড়ি ও দেখি। ওই সব ধনী তাঁদের সম্পদের তথ্য লুকান না। নিজেরাই প্রকাশ করেন। যাঁরা বিভিন্ন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক, তাঁদের সম্পদের তথ্য পাওয়া আরও সহজ। খুব সহজে জানা যায় সম্পদ বৃদ্ধি বা হ্রাসের তথ্যও। ফোর্বস বা ব্লুমবার্গ-এর মতো সংবাদমাধ্যম সারা বছর ধনীদের নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা করে। এই তো ১৭ মার্চ ফোর্বস বিশাল আয়োজন করে ২০১৭ সালের শীর্ষ ধনীর তালিকা প্রকাশ করেছে। এসব তালিকায় নাম ওঠা নিশ্চয়ই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ধনীদের জন্য বিশেষ কিছু। মর্যাদা বাড়ায় এই তালিকা।
কিন্তু বাংলাদেশের শীর্ষ ধনী কে বা কারা, কত তাঁদের সম্পদ—এ তথ্য পাওয়া যায় না। এখানে যাঁদের অনেক সম্পদ, তাঁরা কেউই তার হিসাব দিতে আগ্রহী হন না। সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন থাকে বলেই এই লুকোচুরি। জানার একমাত্র উপায় হতে পারত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া সম্পদের হিসাব। কিন্তু সমস্যা এখানেও আছে। এমনও দেখা গেছে, একই ব্যক্তি কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য এনবিআরকে দিয়েছেন কম সম্পদের হিসাব, আর ব্যাংকঋণ পেতে দিয়েছেন বেশি সম্পদের তথ্য। শীর্ষ ধনী যাঁরা, তাঁরা সব ধরনের কর দেওয়ার পরেই শীর্ষ ধনী। বাংলাদেশে উল্টো। কর দেন না বলেই অনেকে এখানে বিরাট ধনী।
বাংলাদেশের শীর্ষ করদাতা জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া। বছরে ছয় কোটি টাকা কর দেওয়ার কথা তিনি নিজেই জানিয়েছেন। এ হিসাবে তাঁর আয় ও সম্পদের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকার ধারেকাছেও থাকার কথা নয়। ১০০ কোটি ডলারের সম্পদ না থাকলে তো শীর্ষ ধনীদের তালিকায় নাম ওঠানো সম্ভব নয়। আবার এমন অনেক ধনী আছেন, যাঁরা বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন, ততোধিক বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন। তবে এই বাড়ি-গাড়ি কাগজে-কলমে কোম্পানির নামে। কোম্পানির চেয়ারম্যান বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার কারণে কোম্পানি বাড়িতে থাকতে দেয়, গাড়িতে চড়তে দেয়। বাংলাদেশে এ রকম কৌশলী ধনীর সংখ্যাই যে বেশি, তা জানা যায় এনবিআর সূত্রে। রবীন্দ্রনাথের সেই কথা মনে পড়ছে, ‘ধন জিনিসটাকে আমাদের দেশ সচেতনভাবে অনুভব করিতেই পারিল না, এইজন্য আমাদের দেশের কৃপণতাও কুশ্রী, বিলাসও বীভৎস। (বোম্বাই শহর, পথের সঞ্চয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
কিছু অনলাইন পত্রিকার সুবাদে বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ ধনীর একটি তালিকা পাওয়া যায়। তবে এর উৎস কী, তার কোনো উল্লেখ নেই। সহযোগী দৈনিক বণিক বার্তা একবার আয়কর বিবরণীতে ১০০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ দেখিয়েছেন এমন ১০ ব্যক্তির তালিকা প্রকাশ করেছিল। ২০১৩-১৪ করবর্ষ সম্পদের হিসাব ধরে তালিকাটি করা হয়েছিল। সেই তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরীর সম্পদ ছিল সবচেয়ে বেশি, ২৭৫ কোটি টাকা। আর সালমান এফ রহমানের সম্পদ ছিল ১৬৫ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ করবর্ষ ধরে সরকার শীর্ষ করদাতার যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে সবার ওপরে নাম কাউছ মিয়ার। অবশ্য আগেই বলেছি, আয়কর বিবরণীতে দেওয়ার তথ্য মেনে প্রকৃত সম্পদের হিসাব বের করা বাংলাদেশে কঠিন। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য দেওয়া হয় না।
বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের বড় অংশই নিজ চেষ্টায় বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। বিশেষ করে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ধনীরা অর্থ অর্জন করেছেন নিজেদের চেষ্টায়। আবার অনেকে ধনী হয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। এর বাইরে আরেক শ্রেণির ধনী আছেন, যাঁরা রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ধনী হয়েছেন। এমন সংখ্যাও কম নয়। মূলত লাতিন আমেরিকা ও রাশিয়ার ধনীদের বেশির ভাগ এই গোত্রের। একে বলা হয় ক্রনি ক্যাপিটালিজম।
আর বাংলাদেশে? প্রথমত, আশির দশকে ছিল ব্যাংক লুটপাটের কাহিনি, নব্বইয়ের দশকে শেয়ারবাজার লুটপাটের কাহিনি। এর পরের প্রায় দুই দশকে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটপাট—দুটোই ঘটেছে। বাংলাদেশে একটি শ্রেণি বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়েছে মূলত এই দুই পথেই। আমরা এমন কয়েকজন ব্যবসায়ীর কথা জানি, যাঁদের নামে-বেনামে নেওয়া ব্যাংকঋণের পরিমাণই ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা।
অনেকেরই দেশের ভেতরে তো বটেই, বিদেশেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এমনকি পাঁচতারকা একাধিক হোটেলের মালিকানার খবরও পাওয়া যায়। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাই হারান কম করে হলেও ৩০ হাজার কোটি টাকা। কেউ কেউ মনে করেন, অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি, এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। হল-মার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ কোথায় গেল? এভাবে অর্থের হিসাব করলে কিন্তু শীর্ষ ধনীর তালিকায় একাধিক ব্যবসায়ীর নাম থাকা উচিত।
বাংলাদেশে শীর্ষ ধনীদের তালিকা চাই। আয়কর বিবরণীতে সম্পদের হিসাব ঠিকঠাক দিলে তালিকাটি করা সহজ। এমন দিন নিশ্চয়ই আসবে, তখন তালিকায় নাম উঠলে শীর্ষ ধনীরা অস্বীকার করবেন না; বরং একে মর্যাদা বলেই মনে করবেন।
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@gmail.com