আর কোনোদিন রেললাইন ধরে হাঁটব না

কবীর আলমগীর

চারটায় অফিস। ভাবছি বৃষ্টিতে আটকা পড়ায় অফিসে যেতে দেরি হলো আজ। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় অফিসে যেতে হবে। কিংবা ছেলেকে তার নানাবাড়ি রেখে এলাম, আমার জন্য সে এখন কাঁদছে না তো? এসব চিন্তা করতে করতে আরজতপাড়ার রেললাইন ধরে মহাখালী রেল ক্রসিংয়ের দিকে আসছিলাম। একবার সামনেও তাকালাম। ট্রেন আসছে কি না? যাক সামনের দিক থেকে ট্রেন আসেনি।

রেললাইনের মাঝ বরাবরই হাঁটছি। হিজিবিজি চিন্তা করতে করতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি। একবারও মনে হয়নি রেল লাইন দিয়ে হাঁটছি। রেল লাইনের পেছনে তাকাইনি, শুধু একবার সামনে তাকিয়েছি।

তখনো কিছুটা বৃষ্টি পড়ছে। লাইনের ওপার থেকে ছাতা মাথায় এক লোকের ডাক।

অপরিচিত লোকটার ডাক প্রথমে গুরুত্ব দিইনি অথবা শুনতে পাইনি। আবারও তিনি ডাক দিলেন। কী যেন বললেন; প্রথমে শুনতে পেলাম না। তার দিকে এবার তাকালাম। স্পষ্ট অক্ষরে তিনি জানান দিলেন, ‘পেছন থেকে ট্রেন আসছে।’ তাকিয়ে দেখি আমার ঠিক ২০ হাত দূরে ট্রেন। কেমন যেন সাইরেন না বাজিয়েই চুপি চুপি ট্রেনটি ছুটে আসছে। কিংবা ট্রেন আসার শব্দ আমার কানে আসেনি, অন্যমনস্ক ছিলাম বলে।

লাফ দিয়ে লাইনের পাশে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ালাম। দেখলাম চুপি চুপি নয়, কেমন যেন গর্জন করতে করতে ট্রেনটি ছুটে যাচ্ছে তার গন্তব্যে। আমার কাছে মনে হলো ব্যর্থ এক মৃত্যুদানব চিৎকার করতে করতে ছুটছে।

লোকটি না ডাকলে আর এক মিনিট পরেই নির্ঘাত ট্রেনে কাটা পড়তাম। আমি একটা পত্রিকাতে চাকরি করি। অন্তত এটুকু বলা যায়, আমি মারা গেলে দুই একটা পত্রিকায় নিউজ হবে। অন্তত চুপিসারে, নির্জনে আমার মৃত্যুটি হবে না।

আমার পরিচিত কর্মীরা অতি শোকে উৎসাহিত হয়ে তাদের পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে আমার প্রতি দায়িত্ব পালন করতেন। হয়ত শিরোনাম হতো : অফিসে আসার পথে ট্রেনে কাটা পড়ে সাংবাদিকের মৃত্যু কিংবা ট্রেনের চাকায় গেল সাংবাদিকের প্রাণ। অতি উৎসাহী কোনো অনলাইন নিউজ পোর্টাল শিরোনাম করত : চলন্ত ট্রেনে লাফিয়ে সাংবাদিকের আত্মহত্যা। হয়ত তারা খুঁজে ফিরতেন কর্মস্থলে কোনোদিন অপমানিত হয়েছি কি না? সেই অপমানে আত্মহত্যা করেছি কিংবা আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার ঝগড়াঝাটি ছিল কি না? আমার সহকর্মীরা মলিনমুখে একদিন তাদের ডিউটি করতেন, কেউ কেউ হয়ত গোপনে কাঁদতেন কিংবা আমার শত্রু ভাবাপন্ন সহকর্মীদের কেউ কেউ আমার মৃত্যুতে কিছুটা স্বস্তি পেতেন।

আমার মিডিয়া হাউজ থেকে হয়ত দুই-তিন মাসের বেতনের সঙ্গে বাড়তি কিছু টাকা যোগ করা হতো। আমার স্ত্রীর জন্য, আমার সন্তানের জন্য তা হতো অনুদান। মলিনমুখে আমার বিধবা স্ত্রী সেই টাকাগুলো হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। পরের দিন আমার ডেস্কে নতুন কেউ বসতেন। যাই হোক বেঁচে গেছি, বেঁচে আছি।

ট্রেন চলে যাওয়ার পর ওই লোকটিকে খুঁজছিলাম। অন্তত একটা ধন্যবাদ পাওনা তার। লোকটিকে পেলাম না। অগণিত লোকের মাঝে লোকটি মিশে গেছে কিংবা তাকে চিনতে পারিনি। অচেনা সেই মানুষটার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

বি. দ্র : রেল লাইন ধরে হাঁটতে আমার ভালো লাগে। কেমন যেন আনন্দলাগা কাজ করে। তবুও এ ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় আর কোনোদিন রেললাইন ধরে হাঁটব না। যতই সচেতন থাকি না কেন অ্যাবসেন্ট মাইন্ড হতে কতক্ষণ? আর সেই সময়েই ঘটে যেতে পারে বড় কোনো অঘটন। অন্তত রেল লাইন দিয়ে হাঁটার সময় আপনারাও সচেতন হোন।

ফেসবুক থেকে

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts