মাসুদুল হাসান
১৪ এপ্রিল ঘটা করে পালিত হবে বাংলা নববর্ষ। এই নববর্ষ উদযাপনে দিন দিন নিত্যনতুন অনুষঙ্গযুক্ত হচ্ছে এবং আমাদের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতির সাথে যা মিশে যাচ্ছে। হয়তোবা এটা সময়েরই দাবি। তবে আমরা যাই করিনা কেন, শিকড়ের দিকে দৃষ্টি থাকতে হবে আমাদের।
বাংলা সন সৌরপঞ্জিকা ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। বাংলাদেশ এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলে এই বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ঋতু বৈচিত্রকে ধারণ করবার কারণে বাংলা সনের এই জনপ্রিয়তা।
বর্তমানে প্রচলিত বাংলা সন কে বৈজ্ঞানিক ভাবে নির্ধারন করা হয় দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নেই মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ।
নববর্ষ উদযাপন প্রথমে হতো ১লা অগ্রহায়ণে। হায়ণ শব্দের অর্থ বছর বা সূর্যের একটি পরিক্রমণ এর সময়। সম্রাট আকবরের সময় প্রচলিত বাংলাসনের আগে বাংলাদেশে নববর্ষ উদযাপিত হতো এই ১লা অগ্রহায়ণ। এছাড়া কার্তিক ও চৈত্র মাসকেও বিভিন্ন সময় বৎসরের প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হতো। আকবরের সময়কাল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত।
বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষের দিনগণনা সমস্যা দূর করেন ডঃ মুহম্মদ শহীদূল্লাহ। তার সংস্কার গুলো হচ্ছে-
১. বছরের প্রথম পাঁচ মাস বৈশাখ হতে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের ২. বাকী মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন হতে চৈত্র হবে প্রতিটি ৩০ দিনের মাস ৩. প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের। বাংলা একাডেমী সরকারীভাবে এই সংশোধিত বাংলা মাসের হিসাব গ্রহণ করে ।
মূলত পহেলা বৈশাখ গ্রাম বাংলার একটি অবিচ্ছেদ্য জীবনাচারের অংশ, এদিন পুরাতন বছরের হিসেব চুকিয়ে নতুন বছরের হিসেব খোলা হয়। যদিও মাত্রাতিরিক্ত আধুনিকতার জোয়ারে হারিয়ে আজ হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার পহেলা বৈশাখ, জন্ম নিয়েছে নতুন এক হাইব্রিড পহেলা বৈশাখ। যেখানে হাজার টাকায় পান্তা ইলিশ খাওয়া হয়, বৈশাখী কনসার্ট আয়োজন করা হয়, বৈশাখী ডিজে পার্টি, বৈশাখী ফ্যাশন শো হয়, আরও কত কি হয় তা আমার জানা নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি যে কোন উৎসব পালন করার স্বাধীনতা রাখেন যে কোনভাবে, কিন্তু সেই উৎসবকে আপনার মনের মত করে রাঙিয়ে কোন গোষ্ঠী, দল, জাতির কাছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিতে পারেন না। এই উন্মুক্ত তথ্যপ্রবাহের যুগে ইতিহাস আমাদের দোরগোড়ায় চলে আসবেই। চলে আসবে কৃষিভিত্তিক বাংলার বর্ষবিদায় আর বর্ষবরণ।
হালখাতা, বর্ষ শেষের ঝাড়ামোছা আর গ্রাম বাংলার সেই বৈশাখী মেলা।
সময় বা কাল গননা মানব সভ্যতার উন্মেষ থেকেই হয়ে আসছে। সৃষ্টির সাথে সাথেই উদ্ভব হয়েছে সময় এর। আর এর পরিমাপের জন্য বিভিন্ন একক এর।
সময় হচ্ছে একটি একমুখি মাত্রা। যাকে কখনও পিছিয়ে নেয়া যায়না। সময় এর একটি প্রধান একক হচ্ছে বছর। আমরা ছয়টি ঋতু গণনা করি। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চারটি ঋতু বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত এবং শীত ঋতুর সাথে এই অঞ্চলে যোগ হয়েছে বর্ষা ও শরৎ ঋতু। বাংলা সনের মাসগুলোর উপর ভিত্তি করেই এই ঋতু বিভাজন করা হয়েছে। কিন্তু কেন?
কারণ বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমন্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। যেমন : বৈশাখ – বিশাখা নক্ষত্রের; জ্যৈষ্ঠ – জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; আষাঢ় – উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে; শ্রাবণ – শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; ভাদ্র -উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; আশ্বিন – অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে; কার্তিক – কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; অগ্রহায়ণ(মার্গশীর্ষ) – মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; পৌষ – পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; মাঘ – মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে; ফাল্গুন – উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে; চৈত্র – চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে। বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই সাত দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারকামন্ডলীর উপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে “মঙ্গল শোভাযাত্রা”। ধীরে ধীরে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বৈশাখী সঙ্গীতানুষ্ঠানের।
বাঙ্গালির বর্ষবরণ নানা আয়োজন বাজবে ঢোল আর ঢাক, এটাইতো স্বাভাবিক। প্রকৃতির খেলায় নাগর দোলায় মেয়েদের লাল পেড়ে শাড়ি, কানে দুল , কিশোরীর খোপায় পরে গাঁদা ফুল। ছেলেরা গায়ে পড়ে লাল-সাদা রঙের বিভিন্ন পাঞ্জাবী আর পায়জামা ও ফতুয়া। আনন্দ উল্লাসে বৈশাখী মেলা, ভাসিয়ে সুখের ভেলা, মাটির পুতুল, কানের দুল, পাটের ছিকা, তাল পাতার পাখা, বাঁশের বাঁশি, সোলার পাখি, শামুকের মালা –এমনি আনন্দের কতো কী উপকরণ। শহরের মুক্তাঙ্গনে, কবিতা পাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঢাকায় রমনার বটমূলে সহ দেশের প্রতিটি বটমূলে সবাই নাচবে গাইবে প্রাণ খুলে। ডিম ভাজি আর পান্তা ভাত, নববর্ষের রেওয়াজ হয়ে থাক।
বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক ঢাকার অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতিবছরের মত এবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে আজ সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিন করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হবে। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহন করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপ। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।
পয়লা বৈশাখে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় এর সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, এটা বাঙালির ঐতিহ্যের একটি অংশ। এর সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্রতা খোঁজা উচিত নয়।
প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে পয়লা বৈশাখে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি শিা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এই শোভাযাত্রা বের করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে যারা ধর্মের সম্পর্ক খুঁজেন তারা এটা বুঝে করছেন কি না তা আমি জানি না। এখানে ধর্মের কী আছে!’ এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি না ছড়াতে সবার প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। জননেত্রী শেখ হাসিনা যুক্তি দিয়ে বলেন, আমরা মঙ্গলবার বলি। এই মঙ্গলবার বলতে গিয়ে কেউ কি বলি এটা হিন্দুদের। মঙ্গল বার হতে পারলে মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাধা কোথায়-প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় পয়লা বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার সংস্কৃতিরও বিরোধিতা করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, পান্তা-ইলিশের সঙ্গে পয়লা বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই। এজন্য তিনি পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ না খেতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের পর পর ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান।
এবার বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে দেশবাসীকে ইলিশের বদলে সবজি, মরিচ পোড়া ও ডিম ভাজি খাওয়ার আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পহেলা বৈশাখে কেউ ইলিশ খাবেন না। ইলিশ ধরবেন না। কারণ ইলিশ ধরায় নিষেধ আছে। তাই খিচুড়ি খাবেন, সব্জি খাবেন, মরিচ পোড়া খাবেন, ডিমভাজি খাবেন। কিন্তু ইলিশ খাবেন না।’
এখন ইলিশের বড় হওয়ার মৌসুম। এ কারণে জাটকা সংরণের জন্য ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব নদীতে ইলিশ ধরা,মজুদ ও পরিবহন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। গত বছরও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে পহেলা বৈশাখের আয়োজনে ইলিশ ছিল না। আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী ইলিশ বর্জন করবো, এটাই আজ আমাদের অঙ্গীকার। ইলিশরা বেড়ে উঠুক, আর সমৃদ্ধ হোক আমাদের অর্থনীতি, এটাই প্রত্যাশা করি। সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।
মাসুদুল হাসান : সহ অর্থ বিষয়ক সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড কেন্দ্রীয় কমিটি।